Saturday, December 7, 2024

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী

অসাধারণ প্রজ্ঞার এক নারী

বেগম ফজিলাতুন নেছা। ছবি: সংগৃহীতবাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল চরিত্র হচ্ছেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। কিন্তু ইতিহাসে তিনি নিতান্তই উপেক্ষিত। বড়জোর বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী হিসেবে তাঁকে উল্লেখ করা হয়। অথচ তিনি না থাকলে দীর্ঘ লড়াইয়ের পথ অতিক্রম করে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হতে পারতেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বঙ্গবন্ধুর দিন কেটেছে মিটিং, মিছিল, দাবি, স্লোগান আর কারাবাসে। কিন্তু এ সময় তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবা, সন্তানদের দেখভাল, সংগঠনের খবর বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছানো, বঙ্গবন্ধুর বার্তা নেতা-কর্মীদের কাছে নিয়ে আসা, এমনকি নেপথ্যে থেকে সংগঠন পরিচালনার কাজও ফজিলাতুন নেছাই করেছেন।

ফজিলাতুন নেছার এ অনন্য ভূমিকাকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘রেণু আমার পাশে না থাকলে এবং আমার সব দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, বারবার কারাবরণ, ছেলেমেয়ে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনযাপন হাসিমুখে মেনে নিতে না পারলে আমি আজ বঙ্গবন্ধু হতে পারতাম না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামেও যুক্ত থাকতে পারতাম না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় সে আদালতে নিত্য হাজিরা দিয়েছে এবং শুধু আমাকে নয়, মামলায় অভিযুক্ত সবাইকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি জেলে থাকলে নেপথ্যে থেকে আওয়ামী লীগের হালও ধরেছে।’

বঙ্গবন্ধু বেগম ফজিলাতুন নেছার নানা পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। নারীদের সহযোগিতার ইতিহাসকে পুরুষেরা যেন না ভুলে যায় এ প্রসঙ্গে নিজের স্ত্রী ফজিলাতুন নেছার দূরদর্শিতা ও অবদানের উল্লেখ করে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনো দিন আমার স্ত্রী আমাকে বাধা দেয় নাই। এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনো দিন মুখ খুলে আমার ওপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধ হয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত।

এমন সময়ও আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সা দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে লেখা হয়। মহিলার নাম বেশি ইতিহাসে লেখা হয় না। সে জন্য আজকে আপনাদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইয়েরা আমার, যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে।’

শেখ ফজিলাতুন নেছার ডাক নাম ছিল রেণু। যখন তাঁর বয়স ১৭-১৮, তখন থেকেই ছেলেমেয়ে-সংসার সামলাতেন। ছেলেমেয়েদের সুরুচিও গড়ে উঠেছে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা-দীক্ষা থেকেই। কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জাতির জনক হতে পেরেছিলেন বেগম মুজিবের সমর্থনের কারণে। বেগম মুজিব কখনো বলেননি, তুমি রাজনীতি কোরো না, তুমি জেলে গেলে আমাদের কী হবে। বরং বলেছেন উল্টোটা। তুমি দেশের জন্য কাজ করো, আমাদের কথা ভেবো না।’ 

বাংলাদেশের ইতিহাসের তিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ইতিহাস-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রথমটি ঘটেছিল ১৯৬৯ সালে। শেখ মুজিবকে আটকে রাখা হয়েছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। সারা পূর্ব বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। ওদিকে ভুট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানেও হচ্ছে প্রচণ্ড আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। আইয়ুব খান দিশেহারা। এ অবস্থায় তিনি ঠিক করলেন, তিনি গোলটেবিল বৈঠক করবেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হবে। এ সময় বেগম মুজিব ভেবেচিন্তে দেখলেন, প্যারোলে মুক্তি নেওয়া ঠিক হবে না। শেখ মুজিব যদি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে যান, তাঁকে অবশ্যই নিঃশর্ত মুক্তি অর্জন করে নিতে হবে।

বেগম মুজিব তাঁর বড় মেয়ে আর জামাতা ওয়াজেদ মিয়াকে পাঠালেন ক্যান্টনমেন্টে। চিরকুট দিলেন। শেখ হাসিনা আর ওয়াজেদ মিয়াকে শিখিয়ে দিলেন কী বলতে হবে। বেগম মুজিবের কড়া নির্দেশ—জনগণ তোমার সঙ্গে আছে। তুমি কিছুতেই প্যারোলে মুক্তি নেবে না। তোমাকে বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসতে হবে।

দ্বিতীয়টি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণের দিন। মার্চ থেকেই বাংলা কার্যত স্বাধীন। সারা বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সবকিছু চলছে আওয়ামী লীগের নির্দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করা হয়েছে। ২ মার্চ ছাত্ররা সেই পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে, তুলে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে। এরই মধ্যে ইয়াহিয়া খানের ‘অ্যাসেম্বলি’ স্থগিতের ঘোষণা বারুদে অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছে মাত্র। সারা বাংলা জ্বলছে। বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চে ভাষণ দেবেন। কী বলবেন তিনি। ছাত্ররা চায় আজই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করুন আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু আমেরিকানদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তারা সমর্থন করবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ফোন করে অনুরোধ করেছেন, সবকিছু বন্ধ করে দেবেন না।

‘শেখ হাসিনার কিছু স্মৃতি কিছু কথা’ (মঞ্জুরুল ইসলাম) বই থেকে জানা যায়, ‘বাসায় গিজগিজ করছে মানুষ। বেগম মুজিব সবাইকে তাঁদের ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। ঘরে তখন বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব আর হাসিনা। তিনি বললেন, তুমি ১০টা মিনিট শুয়ে রেস্ট নাও। শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘আমি মাথার কাছে বসা, মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন, মনে রেখো, তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলির নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায়, সেটা দেখা তোমার কাজ। তুমি মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করো, কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো। এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শুনবার তোমার দরকার নেই। এই মানুষগুলির জন্য তোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা।’

বঙ্গবন্ধু ১০ মিনিট বিশ্রাম করলেন, গাড়িতে উঠলেন, শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে বীরের মতো হেঁটে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন এবং শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
এই ভাষণের পেছনেও রয়েছে ফজিলাতুন নেছার প্রজ্ঞাময় পরামর্শ।

 তৃতীয় ঘটনাটি ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চের। পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বাংলার ঘরে ঘরে উঠেছে বাংলার পতাকা। এদিকে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছে। এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন, ‘ওই দিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, “এত দিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো, কিছু তো বলছ না।

তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করো, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধামতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।” এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, “আলোচনা এখনো চলছে, এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না।” এরপর বেগম মুজিব অভিমানহত হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে করণীয় সম্পর্কে নিজের মত বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বেগম মুজিবের ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝার জন্য উল্লিখিত ঘটনাটিই যথেষ্ট। প্রকৃতপক্ষে একজন বাঙালি গৃহিণী থেকে তিনি ক্রমেই হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত রাজনৈতিক উপদেষ্টা। 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৫৪ বছরের জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটিয়েছেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন, প্রায় ১৩ বছর কেটেছে কারাগারে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁকে বন্দী হিসেবে নেওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এই সময়টায় ঢাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সামরিক বাহিনীর প্রহরায় গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। শুধু মুক্তিযুদ্ধের এই বন্দী সময় বাদে, বঙ্গবন্ধু জীবনে যতবার জেলে গেছেন, সেখানেই নিয়মিত হাজির হয়েছেন বেগম ফজিলাতুন নেছা। নিয়মিত জেলগেটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের নির্দেশনা এনে দিতেন নেতা-কর্মীদের। পারিবারিক দায়িত্বের পাশাপাশি এই রাজনৈতিক দায়িত্বও নিয়মিত পালন করতেন বেগম ফজিলাতুন নেছা।

 একাত্তরে বেগম মুজিব পরিবারসহ আটক হন। এর মধ্যে দুই পুত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তখন বড় মেয়ের সন্তান হলো। এমন পরিস্থিতিতে সব সামলালেন বেগম মুজিব। এই ‘সবকিছু সামলানো’র সক্ষমতা নারীদের বেশি। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব জীবনভর তা প্রমাণ করে গেছেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে তাঁর অবদানও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

 

spot_imgspot_img

ছবিটা তুলে রাখুন ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে : ড. ইউনূস

গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগে করা মামলায় জামিন পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।...

মায়ের ঘুমপাড়ানি সুর শান্তিধারা

আমাদের জোনাকজ্বলা গ্রাম বিদ্যুৎ তখনও দেখেনি। সন্ধ্যার কাছে বিকেল নতজানু হতেই সবুজ পাহাড়েরা মিশকালো হয়ে যায়। ফলে- আমরা চালের ফুটো দিয়ে চাঁদ দেখি, আর...

মাহবুবা ফারজানা নতুন তথ্য সচিব

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বেগম মাহবুবা ফারজানা। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ছিলেন। তাকে সচিব পদে পদোন্নতি...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here