রাভেন তঞ্চঙ্গ্যা আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আগামীকাল জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে রাভেন তঞ্চঙ্গ্যার। দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল থেকে যেন আক্ষরিক অর্থেই বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে সমতল তথা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে ভর্তি হতে পেরেছেন এই তরুণ। কাল রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আরো ৬৫ জন নবীন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ক্লাস শুরু করবেন রাভেন তঞ্চঙ্গ্যা।
রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম ফারুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রাভেন।
তাঁর গ্রামের নাম পশ্চিম মন্দিরাছড়া, যা রেংখ্যং নদীপথে রাঙামাটি শহর থেকে ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। রাভেনদের পরিবারের নিজেদের জায়গা জমি নেই। মা-বাবা দুজনই দরিদ্র জুম চাষি। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
যতীন্দ্রের স্বপ্নটুকু ছিল
রাভেনের বাবা যতীন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, মা লুক্ষ্মিলতা তঞ্চঙ্গ্যা। তিন ভাই-বোনের মধ্যে রাভেন সবার বড়। তাঁর গ্রাম পশ্চিম মন্দিরাছড়ায় সড়কপথে যাতায়াতের উপায় নেই। চলাচলে বর্ষায় নৌকা আর শীত-খরায় নদী শীর্ণ হলে পায়ে হাঁটা ভরসা।
প্রত্যন্ত জনপদটির কয়েক কিলোমিটার পূর্ব দিকেই ভারতের মিজোরাম। বন ও পাহাড়ের কোলের গ্রামটিতে অনেক ‘নেই’-এর মধ্য দিয়েই বড় হয়েছেন রাভেন। গ্রামে নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। নেই চিকিৎসাকেন্দ্র। পৌঁছায়নি বিদ্যুৎ।
কিন্তু এত সব ‘নেই’য়ের মধ্যেও যা জোরেশোরেই ছিল তা হচ্ছে বাবা যতীন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার রঙিন স্বপ্নটি। অভাবের কারণে যতীন্দ্র নিজে প্রথম শ্রেণির গণ্ডির বেশি পার হতে পারেননি। তাই চেয়েছিলেন বড় সন্তান, একমাত্র ছেলেটাকে যত দূর সম্ভব পড়াবেন। জুমের কলা, শসা, আদার ভালো দাম পাওয়ার আশায় কখনো কখনো যেতেন একটু দূরের বিলাইছড়িতে। তখন পথে দেখতেন সুন্দর পোশাকে স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসা করা ছেলেমেয়ের দল। স্বপ্ন দেখতেন রাভেনও একদিন ইউনিফর্ম পরে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাবে। স্বপ্নপূরণে শিশু ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এক বোনের বাড়িতে, ফারুয়ায়। ছেলেকে ভর্তি করা হলো ফারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পিসির বাড়িতে থেকে পড়াশোনা চলতে থাকে রাভেনের। পিসিকে বাড়ির নানা কাজে সাহায্য করতেন শিশু রাভেন। প্রায়ই মায়ের কথা মনে পড়ত বলে সেখানে মন মানত না।
কিন্তু বাবার ভয়ে বাড়ি যেতে পারতেন না। একসময় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে রাভেন ভর্তি হলেন ফারুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে সপ্তম শ্রেণিতেই ক্লাসে প্রথম হলেন। অষ্টম শ্রেণিতে পেলেন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপি এ ৪.৪৪ পেয়ে এসএসসি পাস করলেন।
হঠাৎ বিপর্যয়ে লেখাপড়া নিয়ে শঙ্কা
এসএসসির পর রাভেন ভর্তি হলেন বান্দরবান সরকারি কলেজে। সেখানে তঞ্চঙ্গ্যা হোস্টেলে বিনা পয়সায় থাকার সুযোগ মিলল। তবে খাওয়া খরচ নিজের। প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকতেই একদিন খবর পেলেন গ্রামে আগুন লেগেছে। দ্রুত বাড়ি ফিরে দেখলেন, ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিভাবে দুমুঠো খেয়ে-পরে বাঁচবেন তা নিয়েই ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন রাভেনের মা-বাবা। তখন তাঁদের সঙ্গে পাহাড়ে দিন-রাত পরিশ্রম করতে লাগলেন রাভেন। এই সময় তাঁদের কোনো কোনো দিন একবেলা খেয়েও কাটাতে হয়েছে। কয়েক মাস ধরে কলেজে যাওয়া বন্ধ ছিল। বইপত্রের সঙ্গেও সম্পর্ক একপ্রকার চুকে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল আর বুঝি পড়ালেখা হবে না! কিন্তু যতীন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তা হতে দিলেন না। দুটো গরু ছিল। বিক্রি করে ঘর তুললেন। ধারকর্জ করে কিছু টাকা জোগাড় করে ছেলেকে বললেন, ‘কলেজে যাও। লেখাপড়া বাদ দিও না।’
এবার ডেলিভারি বয়
হোস্টেলে ফিরে বাবার কষ্ট কিছুটা লাঘবের জন্য প্রবজ্যা ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন রাভেন। কারণ তাতে বিনা পয়সায় বৌদ্ধ বিহারে থাকা-খাওয়ার সুযোগ মিলবে। পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পারবেন। তবে মানতে হবে বিহারের কঠোর নিয়ম-কানুন। একদিন চলে গেলেন রাজস্থলী কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহারে। শ্রমণ (শিক্ষানবিশ ভিক্ষু) হয়ে সেখানে মাস দুয়েক কাটালেন। কিন্তু বিহারের কঠিন নিয়মনিষ্ঠ জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে বড় হওয়া রাভেন। তাই আবার ফিরলেন তঞ্চঙ্গ্যা হোস্টেলে। একদিন ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে ফুড পান্ডার ভেলিভারি বয়ের কাজ শুরু করলেন। নিজের সাইকেলও ছিল না। এক বন্ধুর সাইকেল নিয়ে খাবার ডেলিভারি দিতেন। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি যাই হোক না কেন, নির্দিষ্ট সময়ে কাস্টমারকে খাবার পৌঁছে দিতে হতো। একটু এদিক-সেদিক হলেই বস এবং ক্রেতার কথা শুনতে হতো। পাহাড়ের উঁচু-নিচু রাস্তায় দিনভর সাইকেল চালাতে চালাতে শরীরের অবস্থা হতো কাহিল। ফলে রাতে হোস্টেলে ফিরে পড়ায়ও মন বসত না। এভাবে মাস তিনেক চলল। পরে এক বড় ভাই তাঁকে টিউশনির ব্যবস্থা করে দিলেন। অবস্থা একটু ফিরল। জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে ২০২২ সালে এইচএসসি পাস করলেন রাভেন।
বাবা হাসপাতালে
বাবার আশ্বাস পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংয়ের উদ্যোগ নিলেন রাভেন। শুনেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জুম একাডেমির কথা। সেখানে ভর্তীচ্ছুদের বিনা পয়সায় পড়ান বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া পাহাড়ি তরুণরা। এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সেখানে গিয়ে কোচিং করতে লাগলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সপ্তাহ দুয়েক আগে খবর পেলেন বাবা অসুস্থ। হাসপাতালের বিছানায় শোয়া বাবা যতীন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ছেলেকে দেখে বললেন, ‘দেখো বাবা, জীবনে অনেক বাধা আসবে-যাবে। সব কিছু মানিয়ে নিতে হবে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।’
বহুদূর যেতে চান
বাবাকে হাসপাতালে রেখে রাভেন ফিরলেন চট্টগ্রামে। পরের দুই সপ্তাহ বড়জোর দিনে ঘণ্টা তিনেক ঘুমাতেন। বাকি সময় চলত লেখাপড়া। ঢাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুচ্ছ (সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা) ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। সবখানেই মেধাতালিকায় স্থান পেলেন। তবে অর্থাভাব তখনো পিছু ছাড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এলেন। সবার সহযোগিতায় রাভেন ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। এ জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতাও ঝরল এই তরুণের কণ্ঠে, ‘তাঁরা পাশে না থাকলে হয়তো আমার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যেত।’
এখানেই থেমে যেতে চান না রাভেন। বললেন, ‘আমাকে যেতে হবে বহুদূর। গরিব হয়ে জন্মেছি। কিন্তু গরিব হয়ে মরতে চাই না।’