হাই স্কুল থেকেই অন্যের বাড়িতে ছিলেন। কাজের বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার সুযোগ মিলত। এভাবে পড়েই সুযোগ পেয়েছেন ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এখন ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। খাগড়াছড়ির অংথোয়াইগ্য মারমা নিজের উঠে আসার গল্প শুনিয়েছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ককে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অংথোয়াইগ্য মারমা। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ
এক নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান আমি। শৈশব থেকেই দেখেছি সংসারে কেবল ‘নাই আর নাই’। আমাদের লালছড়ি গ্রামেও কোনো স্কুল ছিল না। পাশের গ্রামে রুপাইছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম।
বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। খুব কষ্ট করে যেতে হতো। বিশাল ধানক্ষেত পেরোলে পাহাড়ি ছড়া। ছড়া পেরিয়ে মিনিট ত্রিশেক হেঁটে গেলে একটি টিলার ওপর বিদ্যালয়টি।
শীতে না হয় হেঁটে যাওয়া যেত, কিন্তু মুশকিল হতো বর্ষাকালে। চারদিকে থইথই পানি। ছড়াটিও টইটম্বুর হয়ে যায়। ছোট ছোট সাঁকো পানিতে তলিয়ে যায়।
যোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে।
তখন পুরো এলাকা ঘুরে যেতাম। দুই ঘণ্টার মতো লাগত। এভাবে পাঁচটি বছর প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে প্রাথমিকের গণ্ডি পার হয়েছি। পাশের গ্রামে একটি জুনিয়র হাই স্কুল ছিল।
কিন্তু ঠিকমতো ক্লাস হতো না। পরে খাগড়াছড়ির রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। সুযোগও মিলল, কিন্তু বাড়ি থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে রামগড় সদরে এসে পড়াশোনা করা কঠিন। তখন বড় দাদা রামগড় কলেজে পড়তেন। দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় থাকতেন। আমিও সেখানে উঠলাম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় দাদার কলেজজীবন শেষ হয়ে যায়। পরে আরেক বাসায় উঠলাম। এসএসসি পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। উঠান ঝাড়ু দেওয়া, ঘর ধোয়া, বাসনকোসন মাজা, কাপড় ধোয়া, বাজার করা—সবই করতাম। রান্নায়ও সহযোগিতা করতাম। বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেতাম। বারান্দায় একটা খাটে ঘুমাতাম। পান থেকে চুন খসলেই কথা শুনতে হতো। দুএকবার মারধরও জুটেছে কপালে। খুব করে মায়ের কথা মনে পড়তো। চোখের জল ফেলতাম। বাবা বলতেন, যা কিছুই ঘটুক লেখাপড়া যেন ঠিক থাকে। এতকিছুর মধ্যেও তাই পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে দিইনি। অষ্টম শ্রেণি থেকেই সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। একবার জেলা পর্যায়ে প্রথম হলাম। আরেকবার বিভাগীয় পর্যায়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছি। নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় পরিচয় হয় মংসাথোয়াই দাদার সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। তিনিই আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখান। বলেন, ‘জানি, তুমি অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করছ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে তোমার কষ্টের দিন শেষ হবে। পারলে ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করো।’ তখন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়। এসএসসি পাসের পর ভাবলাম, ঢাকায় চলে আসব। নটর ডেমে পড়ব। ঢাকায় পড়তে যেতে চাই শুনে বাবা মুখের ওপর ‘না’ বলে দিলেন। বললেন, ‘এমনিতেই সংসার চালানো দায়। ঢাকায় অনেক খরচ। আমি সামলাতে পারব না।’ কিন্তু মনে মনে ঠিক করলাম, ঢাকায় গিয়েই পড়ব। যেভাবেই হোক, ভর্তি হব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বাবার আপত্তি সত্ত্বেও সেদিন বড় দাদা রেম্রাচাই মারমা আমাকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। ভর্তি করিয়ে দিলেন ধানমণ্ডি আইডিয়াল কলেজে। মানবিক বিভাগে।
ঢাকায় থাকব কোথায় তার কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। মংসাথোয়াই দাদার কথা মনে পড়ল। তাঁকে সব খুলে বললাম। তিনি টিউশনি করতেন রায়েরবাজারে। এক সরকারি কর্মকর্তার বাসায়। দাদা তাঁর ছাত্রের মা-বাবাকে রাজি করালেন। পরে সেই বাসায় থাকার বন্দোবস্ত হলো।
আমার মা খুব ভালো রাঁধেন। কোন বোন নেই আমার। মা বলতেন, ‘আমার ছেলেমেয়ে সবই তুই।’ ছোটবেলা থেকেই মা হাতে ধরে রান্নাটা শিখিয়েছেন। বড় হলে সেটা ভীষণ কাজে দিয়েছে। লোকে বলে, আমার রান্নার হাত নাকি ভালো। ঢাকার সেই বাসায় রান্না করতাম। ফ্লোরে ঘুমাতাম। সবার আগে ঘুম থেকে উঠে ঘরদোর পরিস্কার করতাম। ধোয়া-মোছা শেষে রান্না করে তবেই কলেজে রওনা দিতাম। এভাবে জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে এইচএসসি পাস করলাম।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় যাঁর বাড়িতে থাকতাম, ততদিনে তাঁর ছেলে ঢাকায় এসেছে কলেজে ভর্তি হতে। আমি ঢাকায় আছি জেনে তিনি তাঁর ছেলের সঙ্গে থাকতে বললেন। পরে আজিমপুরে চলে এলাম। রান্না করে দেওয়ার সুবাদে এখানেও বিনে পয়সায় থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেলাম। এ সময় পুরোদমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি শুরু করলাম। মংসাথোয়াই দাদা তাঁর বন্ধু জ্যাকি মারমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি পাঁচ মাস আমাকে বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ (সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা) ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খ’ ইউনিটে ২১৫তম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক’ ইউনিটে ২৩৬তম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খ’ ইউনিটে ৩৬৩তম এবং ‘ঘ’ ইউনিটে ১৪৩৩তম হয়েছি। গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ‘খ’ ইউনিটে ২৮২১তম হয়েছি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছি।
জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। নিজের বাড়ি আর লোকের বাড়িতে থাকার মধ্যে অনেক তফাৎ। স্বাধীনতা নাই। একটু এদিক সেদিক হলেই কটু কথা হজম করতে হয়। তবু যারা থাকতে দিয়েছেন তাঁদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। যাহোক, এখানেই থামতে চাই না। আরো বহুদূর যেতে হবে আমাকে।