আল্লামা মাহ্মূদুল হাসান
কোনো বিষয়ে সফলতা লাভ করতে হলে সে বিষয়ে যথার্থ ইলম ও জ্ঞান থাকতে হবে। জ্ঞান না থাকলে কখনো সে কাজে সফলতা লাভ সম্ভব নয়। খুব আমল করছি, কিন্তু সঠিক মাসআলা না জানার কারণে আমার আমলটা বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না; তাহলে তো শুধু সময়ের অপচয় হলো, শ্রমও বৃথা গেল। সব ক্ষেত্রে একই অবস্থা। দুনিয়ার ক্ষেত্রেই ধরুন আপনি আপনার ফাক্টরিতে ১ কোটি টাকার একটা মেশিন ফিট করেছেন। সে মেশিনে ১ লাখ, ১০ হাজার, ২০ হাজার টাকার পার্টস রয়েছে, আবার এমন একটা পার্টসও রয়েছে যেটার মূল্য মাত্র ১ ডলার। অন্য দামি দামি পার্টসগুলো সবই ঠিকমতো ফিট হয়েছে, কিন্তু সেই ১ ডলার মূল্যের পার্টসটা ঠিকমতো ফিট হয়নি। এখন বলুন এ মেশিনে কি প্রোডাকশন হবে? হবে না। কারণ সব ঠিক হলে কী হবে, ওই ছোট্ট একটা পার্টসের কারণে সব গোলমেলে হয়ে যাবে। এখন এর জন্য ইঞ্জিনিয়ারের শরণাপন্ন হতে হবে। এমনিভাবে আজানের সব কালেমার আপনি সঠিক জবাব দিয়েছেন কিন্তু একটি কালেমার জবাব ভুল দেওয়া হয়েছে। ফলে আপনার এ আমলটা অগ্রণযোগ্য হয়ে গেল। এভাবে অনেক মানুষই আমল করছে, কিন্তু ইলম না থাকার কারণে তার আমল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বুখারি শরিফের এক হাদিসে এসেছে, যেটাকে বলা হয়, ‘হাদিসে মুসালসালাত’। ঘটনা হলো এক সাহাবি হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তিনবার নামাজ পড়েছেন। প্রথমবার নামাজ পড়ার পর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যাও পুনরায় নামাজ পড়, তোমার নামাজ হয়নি। সেই সাহাবি আবার নামাজ আদায় করে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলে তিনি বললেন,- যাও, আবার নামাজ পড়, তোমার নামাজ হয়নি। সাহাবি তৃতীয়বার নামাজ পড়ে এলে এবারও রসুল (সা.) বললেন, যাও আবার নামাজ পড়ে এসো, তোমার নামাজ হয়নি। এবার সাহাবি আরজ করলেন, হে আল্লাহর রসুল! আমি এ তিনবারে যেভাবে নামাজ পড়লাম এর চেয়ে ভালোভাবে নামাজ পড়তে পারি না। সুতরাং ‘হে আল্লাহর রসুল! আমাকে নামাজ শিখিয়ে দিন।’ কারণ নামাজের ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নত সম্পর্কে আমার জানা থাকলেও এগুলো আদায় করার বাস্তব তরিকা আমার জানা নেই। সুতরাং আপনি আমাকে প্র্যাকটিক্যালভাবে নামাজ শিখিয়ে দিন। অতঃপর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হাতে-কলমে নামাজ শিখিয়ে দিলেন। কীভাবে দাঁড়াতে হবে, কীভাবে রুকু করতে হবে, কীভাবে সেজদা করতে হবে, এগুলো শিক্ষা দিলেন। এভাবে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও জিব্রাইল (আ.) ১০ বার নামাজ শিক্ষা দিয়েছেন। অথচ তিনি নবী ছিলেন। তথাপি তাঁকে ১০ বার ট্রেনিং দেওয়ার পর তিনি নামাজ পড়া আরম্ভ করেছেন।
যেদিন নামাজ ফরজ করা হলো অর্থাৎ মেরাজের রাতে সেদিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামাজ না পড়ে জোহরের ওয়াক্ত থেকে নামাজ পড়া শুরু করেন। অথচ তিনি ফজরের পূর্বেই মেরাজ থেকে ফিরে আসেন। এখানে অনেকেই না বুঝে বলে থাকে যে, যেহেতু রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজের দীর্ঘ সফর থেকে ফিরে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তাই তাঁর সম্মানার্থে তাঁকে আর ডাকা হয়নি। ফলে ফজরের নামাজ কাজা হয়ে গেছে। এমনকি এ কথাটা অনেকে বইপুস্তকেও লিখে দিয়েছে। এটা তো আহাম্মক বন্ধুর মতো কথা হলো। কারণ সর্বপ্রথম নামাজেই তিনি গায়েব থাকবেন, কাজা করে ফেলবেন, এর দ্বারা কত বড় বদনাম তার ওপর আরোপিত হয়! যেখানে তিনি জেহাদের ময়দানেও নামাজ বাদ দেননি, সেখানে পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে ফজরের নামাজ কাজা করে ফেলবেন? যারা ফজরের নামাজ পড়েন না তাদের জন্য এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ। আসল কথা হলো, আল্লাহপাক রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলে দিয়েছেন, তোমার ওপর এবং উম্মতের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করলাম, তবে এটা শুরু হবে জোহর থেকে। এর আগে জিব্রাইলকে পাঠাব, সে তোমাকে নামাজ শিক্ষা দিয়ে আসবে। আর হজরত জিব্রাইল (আ.) আকাশ থেকে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সর্বপ্রথম জোহরের সময় আসেন। ফজরের সময় আসেননি। সুতরাং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে ঘুমের কথা বলা হয়, এটা অজ্ঞতাপ্রসূত। এমন একটা ঘটনা ঘটার পর কি ঘুম আসতে পারে? এমন ঘটনা আমাদের জীবনে সংঘটিত হলে কি আমাদের ঘুম আসত? এমন ঘটনা তো দূরের কথা রাতের বেলা যদি ফেরেশতা এসে আমাকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে রেখে আসে, তাহলে একদিন কেন এক মাসও আমার ঘুম আসবে না। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহতায়ালা পৃথিবী থেকে সাত আসমান ভ্রমণ করিয়ে আরশ পর্যন্ত নিয়ে গেছেন; সেখানে তার ঘুম আসার প্রশ্নও আসতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি ফজরের নামাজ কেন পড়েননি? উত্তর হলো, নামাজের তালিম তখনো বাকি ছিল। তাঁকে শুধু নামাজের ফরযিয়্যাতের কথা বলে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নামাজের প্র্যাকটিক্যাল অবস্থা তখন পর্যন্ত বলে দেওয়া হয়নি। কীভাবে রুকু করতে হবে, কীভাবে সেজদা করতে হবে ইত্যাদি বলে দেওয়া হয়নি। তাই জোহরের সময় হজরত জিব্রাইল (আ.) এসে পরের দিন জোহর পর্যন্ত এই ১০ ওয়াক্তে প্র্যাকটিক্যালভাবে নামাজ শিক্ষা দিয়েছেন।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ