অর্থভুবন ডেস্ক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রতিবছর বাড়ছে মামলার জট। গত ১৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে বিচারাধীন মামলার জট দ্বিগুণ হয়েছে। দেশের আদালতগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৪২ লাখ মামলা ঝুলছে। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার নেপথ্যে প্রধান কারণ বিচারক স্বল্পতা। এ সংকটসহ ২২টি কারণ তুলে ধরে ‘মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও মামলার জট হ্রাসকরণে আইন কমিশনের সুপারিশ ও সম্মিলিত প্রতিবেদন’ তৈরি করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় প্রতিবেদনে উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ অপ্রতুল বিচারক; বিশেষায়িত আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া; মিথ্যা, ফলহীন ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের; জনবলের অভাব; দুর্বল অবকাঠামো; আদালতগুলোতে মামলার সুষম বণ্টনের অভাব; প্রশাসনিক শৈথিল্য; অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ; কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জবাবদিহিতার অভাব; আইনজীবীদের আন্তরিকতার অভাব; দুর্বল মামলা ব্যবস্থাপনা; জমিজমা-সংক্রান্ত নথিপত্র সংরক্ষণের অভাব; প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যবহারিক জটিলতা; সাক্ষীর অনুপস্থিতি; ক্রমাগত শুনানির অভাব; যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব; নকল সরবরাহের ক্ষেত্রে অনিয়ম; উচ্চ আদালত কর্তৃক নথি তলব হওয়া; সংশ্লিষ্ট মামলার আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিভিশন মোকাদ্দমা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা; উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ প্রভৃতি।
এ ছাড়া দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে সমন ও নোটিশ জারিতে বিলম্ব; বিবাদীর লিখিত জবাব দাখিলে অস্বাভাবিক বিলম্ব; বাদীপক্ষের পুনঃপুন আরজি সংশোধন; অন্তর্বর্তীকালীন দরখাস্ত দাখিলের প্রবণতা; দেওয়ানি আদালতে ছানী মামলার আধিক্য; পরিবারিক মামলায় আপসের অজুহাতে সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি ৮টি কারণ তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে দেশের জনসংখ্যার সঙ্গে বিচারকের সংখ্যার তুলনা করে বলা হয়Ñ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এ সংখ্যাকে দেশের জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে বিদ্যমান বিচারকের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে দেখা যায় যে, ৯৪ হাজার ৪৪৪ জনের বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা মাত্র একজন, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নিতান্তই কম। যুক্তরাজ্যে আনুমানিক বিচারকপ্রতি জনসংখ্যা ৩ হাজার ১৮৬ জন। যুক্তরাষ্ট্রে এটি ১০ হাজার, ভারতে বিচারকপ্রতি জনগণ ৪৭ হাজার ৬১৯ জন এবং পাকিস্তানে প্রায় ৫০ হাজার।
সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থাপিত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৮ সালে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ৬ হাজার ৮৯২টি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৯২৮টি। হাইকোর্ট বিভাগে ২০০৮ সালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২ লাখ ৯৩ হাজার ৯০১টি। একই সময়কালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ১৬ হাজার ৬৭৪টিতে। জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্য আদালতগুলোতে ২০০৮ সালে মামলা ছিল ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১২১টি। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিচারাধীন মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ১টিতে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে উচ্চ আদালতসহ দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩টি। ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৪টি।
২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। গত ১৫ বছরে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এই অস্বাভাবিক মামলাজট নিরসনের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বিচারব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাই শুধু হারাবে না, বিচারব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে।
বিচারক স্বল্পতাকে মামলাজট বা মামলার দীর্ঘসূত্রতার জন্য প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপুলসংখ্যক মামলা পরিচালনার জন্য বিচারকের সংখ্যা অতি সামান্য। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ৮ জন এবং হাইকোর্টে বিচারপতির সংখ্যা ৯০ জন। এ তথ্য অনুযায়ী, আপিল বিভাগে বিচারের জন্য বিচারকপ্রতি মামলা রয়েছে ২ হাজার ৪৯১টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকপ্রতি মামলা রয়েছে ৫ হাজার ৭৪১টি। অপরদিকে, জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে বর্তমানে বিচারকের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এর মধ্যে ডেপুটেশনে রয়েছেন আনুমানিক ২০০ বিচারক। সেই হিসেবে জেলা বিচার বিভাগে বিচারকপ্রতি মামলা আছে ২ হাজার ৩৩টি করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলার জট কমাতে অতিদ্রুত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিচারক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে পদ সৃষ্টি করে কমপক্ষে ৫ হাজার বিচারক নিয়োগ করা হলে বর্তমান মামলার জট কমিয়ে মামলার সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে। অন্তর্বর্তী সমাধান হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচার বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের, জেলা জজদের মধ্য হতে দক্ষ, সৎ, যোগ্য কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পদায়ন করলে পুরাতন বিচারাধীন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার শুনানি, আপিল ও রিভিশন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।