প্রভাষ আমিন
ছেলেবেলায় কোনো একটা সিনেমায় গান শুনেছিলাম- আমি শুইনাছি শুইনাছি টাকার পাখা গজাইছে, শহরেতে টাকা নাকি উইড়া বেড়ায় রে। এখন দেখছি টাকার সত্যি পাখা গজাইছে। শুধু শহর নয়, গ্রামে-গঞ্জেও দেখি উড়ে উড়ে টাকা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। আগে এ প্রতারণার ফাঁদ পাতা কিছুটা কঠিন ছিল। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার কাজটাও সহজ হয়ে গেছে। ফেসবুকে ঢুকলেই কোনো না কোনো অফার পাবেন। কোটিপতি হওয়া যেন কয়েকটি ক্লিকের দূরত্ব। ১০ দিনে টাকা দ্বিগুণ করার ডাক। কোথাও বিনিয়োগ, কোথাও বেটিং, কোথাও ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসা, কোথাও ক্লিক করলেই টাকা কামানোর সুযোগ। ফেসবুকে ঢুকলেই মনে হয় বেকারত্ব কোনো সমস্যাই নয়। হাওয়ায় উড়ে উড়ে টাকা চলে আসবে পকেটে।
সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয় এমটিএফই (মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ) নামে একটি হাওয়াই প্রতিষ্ঠান হুট করে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে- এমটিএফইতে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের ১১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। দুবাইভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে তেমন কোনো অবকাঠামো নেই। তাই তাদের ধরারও কোনো উপায় নেই। কান্নাকাটি, লেখালেখি, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সরকারকে গালাগাল করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। যুবক, ডেসটিনি, ই-ভ্যালির মতো যাদের বাংলাদেশে অফিস ছিল, যাদের মূল হোতারা ধরা পড়েছেন; তাদের টাকাই কেউ পায়নি। আর এমটিএফই তো বায়বীয় কোম্পানি। কে, কী আশ্বাস দেবে জানি না; তবে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি এ ১১ হাজার কোটি টাকার এক টাকাও কেউ ফেরত পাবেন না। বিভিন্ন পত্রিকার খবরে বিভিন্ন অঙ্কের টাকার কথা বলা হয়েছে। সর্বনিম্ন ১১ হাজার কোটি টাকা। কোনো কোনো পত্রিকায় ২০ হাজার কোটি টাকার কথাও লেখা হয়েছে। টাকার অঙ্ক শুনলেও আমি বিস্ময় মানি। ছেলেবেলায় শুনতাম, গ্রামের কেউ বড়লোক হলে বাড়িতে উঁচু বাঁশের মাথায় বাতি জ্বালায়। এটাকে বলত ‘লাখের বাতি’। মানে লাখ টাকা হলেই বাতি জ্বালানোর যোগ্যতা হতো। লাখ টাকা অনেক আগেই ডালভাত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সব লাখপতি নিজেদের বাড়িতে বা বাসায় বাতি জ্বালালে দেশে আর স্ট্রিট লাইট লাগবে না। এখন কোটি টাকাও আলোচনায় আসে না। এখন শুনি শত কোটি, হাজার কোটি টাকা। সরকারি বিভিন্ন অফিসের পিয়ন-ড্রাইভাররাও নাকি শত কোটি টাকার মালিক। মাঝে মাঝে কল্পনা করার চেষ্টা করি, কয় টাকায় কোটি টাকা হয়, শত কোটি টাকা হয়, হাজার কোটি টাকা হয়। ১০০ টাকার বান্ডিলেও ১১ হাজার কোটি টাকা ডাকাতি করতে কয়টা লরি লাগবে? কিন্তু এখন মাত্র কয়েকটা ক্লিকেই গায়েব ১১ হাজার কোটি টাকা।
আমি ভাবি, বাংলাদেশেই কেন বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটে। প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। বাংলাদেশ ঘনবসতি, বেকারত্ব বেশি, শিক্ষা কম, সাইবার শিক্ষা আরও কম, সচেতনতা আরও কম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো মানুষের লোভ। এ লোভকে পুঁজি করেই প্রতারকরা তাদের ফাঁদ পাতে। শুধু দেশে নয়, জমিজমা বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়েও অনেকে প্রতারিত হন, এমনকি মারাও যান। তবে আমাদের লোভের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে আমরা বিভোর। ই-মেইলে পাঠানো বিনিয়োগের অফারে সাড়া দেই আমরা। বিদেশ থেকে দামি গিফট এসেছে শুনে সেটা ছাড়াতে লাখ লাখ টাকা দিয়ে দেই। এমনকি জিনের বাদশারাও আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। এভাবে আমরা শেয়ারবাজারে গিয়ে নিঃস্ব হই, এমএলএম কোম্পানির ফাঁদে পড়ে পথের ফকির বনে যাই। ১৯৯৬ সালের মহাধসের আগে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা এক সাংবাদিক বন্ধু প্রতিদিন কোটি টাকার গল্প শোনাত। লাভের অঙ্ক দেখাত। কোন মডেলের গাড়ি কিনবে, কোথায় বাড়ি বানাবে তার স্বপ্নের কথা বলত। তখনো যদি সে শেয়ার বিক্রি করে দিত, সত্যি কোটিপতি হতো। আমি তাকে বারবার বলতাম, আর দরকার নেই। এবার বিক্রি করে দেন। তিনি বলতেন, আরে রাখেন, আরও কত কোটি টাকা হয় দেখেন। তারপর এক সকালে নিঃস্ব হয়ে যায় সে। তার স্বপ্নভঙ্গের বেদনা কাছ থেকে দেখেছি। শেয়ারবাজার তবু বৈধ বিষয়, বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে লাভক্ষতি থাকে। কিন্তু অবৈধ এমএলএম ব্যবসায় যারা হাওয়ার ওপর কোটিপতি হতে চান, তাদের কথা আলাদা। যুবক, ডেসটিনি বা ই-ভ্যালির তবু নামকাওয়াস্তে হলেও কিছু পণ্য ছিল। তারা জমিজমা কিনেছে বা গাছ লাগিয়েছিল। কিন্তু এমটিএফই তো পুরোটাই হাওয়াই ব্যবসা। ১ লাখ টাকা ব্যাংকে রাখলে আপনি ৭০০/৮০০ টাকা পাবেন। কোনো লাভজনক ব্যবসায় খাটালেও মাসে ৩-৪ হাজার টাকার বেশি পাবেন না। কিন্তু আপনি যদি বিশ্বাস করেন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে মাসে ৪৫ হাজার টাকা লাভ পাবেন, তাহলে সমস্যা তো আপনার। পত্রিকায় দেখলাম, এমটিএফইও স্বপ্নে অনেককে কোটিপতি বানিয়েছিল। অনেকের অ্যাকাউন্টে লাভের লাখ লাখ ডলার জমা ছিল। সেটা দেখে আরও অনেকে ঝাঁপ দিয়েছেন। পতঙ্গ যেমন উড়ে গিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরে যায়। আমরা তেমন লোভের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিঃস্ব হই।
আসলে লাভ আর লোভের পার্থক্যটা আমরা ভুলে যাই। আর কে না জানে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। নিঃস্ব হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করেন। শারীরিক মৃত্যু হয়তো সবার হয় না। কিন্তু একটি পরিবারের আর্থিক সক্ষমতার মৃত্যু ঘটানোর জন্য এমন একটি ফাঁদই যথেষ্ট। যুবক, ডেসটিনি, ই-ভ্যালি, এমটিএফইর ফাঁদে পড়ে কত মানুষ, কত পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
আমার খুব অবাক লাগে, ১১ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু সে অর্থে কোনো আওয়াজ নেই। গণমাধ্যম নিউজ করছে বটে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা খুব বেশি কথা বলছেন না, প্রতারিত হওয়ার কথাও বলছেন না। প্রথম কথা হলো, তারা নিজ দায়িত্বে প্রতারিত হয়েছেন। দ্বিতীয় কথা হলো, তারা অবৈধ পথে টাকাটা পাঠিয়েছেন। টাকা তো গেছেই, এখন আওয়াজ তুলতে গেলে আরও বড় শাস্তির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই টাকা হারিয়েও বেশির ভাগ মানুষ চুপ করে আছেন। কেউ অভিযোগ না করলেও পুলিশ গণমাধ্যমের খবর দেখে নিজেদের মতো খোঁজখবর নিচ্ছে। কিন্তু এটা মানতেই হবে, আপনি আপনার ঘরে বসে মোবাইলে কার সঙ্গে কী লেনদেন করছেন; তার খবর রাখা পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়।
তাই বলে কি এভাবে একের পর এক ফাঁদে পড়ে লোভী মানুষ, অসহায় মানুষ, সরল মানুষ, অসচেতন মানুষ নিঃস্ব হতেই থাকবে? সরকারের কি কিছুই করার নেই। এমটিএফই না হয় আড়ালে ছিল। কিন্তু যুবক, ডেসটিনি, ই-ভ্যালি তো দৈত্য হয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। টাকা নিয়ে ভেগে যাওয়ার পর আমাদের টনক নড়ে। কিছুদিন হইচই হয়, তারপর টাকার মতো সব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এখন পুলিশ বলছে আমরা জানি না, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে আমরা জানি না, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বলছে আমরা জানি না। কেউ যদি না জানে, তাহলে সরকার থাকার দরকার কী। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তো সরকারের।
এমটিএফই কি এ ধরনের শেষ ফাঁদ? আমি জানি, আপনারাও জানেন, পুলিশও জানে; উত্তরটা নেতিবাচক। অন্তর্জাল জগতে এমন আরও অনেক প্রতারণার জাল পাতা আছে। ফেসবুকে ঢুকলে এমন আরও অনেক কোটিপতি হওয়ার, ঘরে বসে আয় করার অফার পাবেন। নিঃস্ব হবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত আপনার।
এ প্রবণতা বন্ধের কি কোনো উপায় নেই? অবশ্যই আছে। অন্তর্জাল জগতে কী হচ্ছে, তা কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সন্দেহজনক কিছু হচ্ছে কি না নজর রাখতে হবে। দায়ীদের ধরে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে এমটিএফইর ৪০০-এর মতো সিইও ছিল, তারা তো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। তাদের ধরে মূল হোতাদের কাছে যেতে হবে। কিন্তু শুরুতেই যেমন বলেছি, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাই। যুবক, ডেসটিনি, ই-ভ্যালির কাউকে কাউকে ধরা হয়েছে বটে কিন্তু এখনো বিচার হয়নি; কেউ টাকাও ফেরত পায়নি। প্রতারণা করে টাকা মেরে দিলেও যদি শাস্তি না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক মানুষ এ ব্যবসায় নামবে, মানুষকে নিঃস্ব করতেই থাকবে।
তবে সবার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। লাভ আর লোভের ফারাকটা বুঝতে হবে। এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে আমাদের সবাইকেই উপার্জন করতে হবে। কিন্তু সেটা করতে হবে পরিশ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে, যোগ্যতা দিয়ে। ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। কিন্তু লটারি সবাই পায় না। আর পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। ছেলেবেলায় পড়েছেন না, এক লোকের হাঁস প্রতিদিন একটা করে সোনার ডিম দেয়। সেই লোভী ব্যক্তি সব সোনার ডিম একদিনে পাওয়ার আশায় হাঁসটিকেই জবাই করে ফেলল।
আমাদের আসলে বুঝতে হবে। ঠিকঠাক মতো লালন-পালন করলে একটা হাঁস দিনে একটাই ডিম পাড়বে। আর পৃথিবীর কোনো হাঁসই সোনার ডিম পাড়ে না। সোনার ডিমের আশায় বসে না থেকে আমাদের প্রতিদিন একটা ডিমের আশায় পরিশ্রম করতে হবে। ঘরে বসে ক্লিকে টাকা আয় করার কোনো শর্টকাট রাস্তা পৃথিবীর কোথাও নেই। তাহলে পৃথিবীতে কোনো গরিব মানুষ থাকত না। সবাই কোটিপতি বনে যেত। ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় মাসে ৪৫ হাজার টাকা বিল গেটস বা ইলন মাস্কও কামাতে পারবেন না। তাই কাউকে দোষ না দিয়ে নিজে সচেতন হোন।
কবি লিখেছিলেন- ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে/কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে’। এখন দেখছি প্রতারণার ফাঁদ পাতা ভুবনে। কে যে কখন, কোন ফাঁদে ধরা পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাবেন কে জানে? তাই সময় থাকতে সাবধান হন। পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য আপনার নিজেকেই গড়তে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক