অর্থভুবন প্রতিবেদক
সদ্য চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির প্রতি নাগরিকদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে। ইতোমধ্যে সাড়ে ৬ হাজার মানুষ নিবন্ধন করে টাকাও জমা দিয়েছেন। তবে কর্মসূচিটির প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের প্রক্রিয়া এখনো অনেকটা বাকি। সরকার জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করে এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ও একজন সদস্য নিয়োগ দিয়েছে; কিন্তু বাকি সদস্য নিয়োগ এখনো প্রক্রিয়াধীন। উদ্বোধনের পর কার্যক্রম শুরু হলেও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের আলাদা কোনো কার্যালয় স্থাপন করা হয়নি। তৈরি করা হয়নি কোনো অর্গানোগ্রামও।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মানুষের আগ্রহ এবং গুরুত্ব বিবেচনায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে কর্মসূচিটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, পেনশন তহবিলের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কাজ চলমান। অর্থ বিভাগের আশা, আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে নিজস্ব কার্যালয়ে এর কার্যক্রম পরিচালিত হবে। মনোগ্রামসহ অন্য কাজগুলোও দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সর্বজনীন পেনশন একটি জনবান্ধব কর্মসূচি হলেও এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি জটিল। যেসব উন্নত দেশে এই কর্মসূচি সফল হয়েছে, সেসব দেশের অধিকাংশ মানুষের পেনশন স্কিমে চাঁদা দেওয়ার অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের সেই সামর্থ্য নেই। এই কর্মসূচির আওতায় সব কর্মক্ষম নারী-পুরুষকে নিয়ে আসতে হলে ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিকে স্বাগত জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তারা জনগণের কাছ থেকে আহরিত অর্থ কোন খাতে ব্যয় করা হবে, সে প্রশ্নও রেখেছেন। যদি এটা উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হয়, তা হলে অর্থনীতি গতিশীল হবে। আর অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হলে অর্থনৈতিক ঝুঁঁকি বাড়বে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এটি অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। তবে পেনশন তহবিলের টাকা কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে সেটি দেখা দরকার। তা না হলে মানুষের টাকা ফেরত দিতে টাকা ছাপাতে হবে। তহবিলের অর্থ তিনি বহুজাতিক ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগের পরামর্শ দেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, এটা একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এ স্কিমটি সেলফ ফাইন্যান্সিংয়ে হবে, নাকি ভর্তুকি দিতে হবে সেটিই দেখার বিষয়।
পেনশন কার্যক্রম চালুর সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আপাতত কাজ চালিয়ে নিতে অর্থ বিভাগের বাজেট ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা উপবিভাগের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খানকে কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন একই উপবিভাগের আরেক অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফা। আরও সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, পেনশন-ব্যবস্থায় নগদ টাকায় কোনো লেনদেন হবে না। সব কাজই হবে অনলাইনে। এপিআই হচ্ছে এক ধরনের সফটওয়্যার, যার মাধ্যমে একটির সঙ্গে একাধিক কম্পিউটার কর্মসূচির যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।
অন্যদিকে অর্থমন্ত্রীকে সভাপতি করে ১৬ সদস্যের পেনশন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। আপাতত আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে। তবে পেনশন কর্তৃপক্ষের আলাদা অফিস ও জনবল কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) না থাকায় কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীও নিয়োগ হয়নি। এর মধ্যে চালু করা হয়েছে একটি ওয়েবসাইট। সেখানে রয়েছে নিয়মকানুন। অনলাইনে ফরম পূরণ করা যায়, আবার ডাউনলোড করেও পূরণ করা যায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নিয়ন্ত্রণ) বিলকিস জাহান রিমি আমাদের সময়কে বলেন, নিবন্ধন উৎসাহব্যঞ্জক। ইতোমধ্যে সাড়ে ৬ হাজার মানুষ নিবন্ধন করেছেন এবং টাকাও জমা দিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে কাজ চলছে। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কার্যালয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। মনোগ্রাম তৈরির কাজও চলছে।
অর্থ বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সর্বজনীন পেনশন ফান্ডে জমা হওয়া টাকা কর্তৃপক্ষের জন্য ব্যয় হবে না। পেনশন কর্তৃপক্ষের যাবতীয় ব্যয় সরকার বহন করবে। ফলে সম্পূর্ণ টাকার ওপরে মুনাফা পাওয়া যাবে। হার অনুযায়ী প্রত্যেকের হিসাবে মুনাফার টাকা চলে যাবে। প্রত্যেকে আইডি নম্বর দিয়ে হিসাবে ঢুকে যে কোনো সময় দেখতে পারবেন কত টাকা জমা দিয়েছেন, লাভ কত হয়েছে, এখন কত টাকা জমা আছে।
জানা গেছে, গতকাল সোমবার পর্যন্ত এ কর্মসূচিতে ৬ হাজার ৫০০ নাগরিক যুক্ত হয়েছেন। তারা কিস্তির টাকা জমা দিয়ে বিভিন্ন স্কিমে নিবন্ধন করেছেন।
পেনশন বিধিমালা বলছে, সর্বজনীন পেনশন প্রথায় যার যত টাকা জমা, মেয়াদ শেষে তার তত বেশি পেনশন। অন্যদিকে, স্বল্প আয়ের মানুষদেরও বিমুখ করবে না এই উদ্যোগ। যারা মাসিক ৫০০ টাকা জমাবেন, তাদের জন্য শুরু থেকেই থাকবে সরকারের আরও ৫০০ টাকার ভর্তুকি। সব মিলিয়ে সবার জন্যই থাকছে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বাড়তি কয়েকগুণ মুনাফা।
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পৃথিবীর বহু দেশেই চালু আছে জাতীয় পেনশন ব্যবস্থা। যেগুলো চলছে ঠিকঠাক। বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন খাতে জমা হওয়া অর্থ যাবে লাভজনক বিনিয়োগে, তা থেকে প্রাপ্ত মুনাফাই জমা হবে স্কিমের হিসাবে। ফলে বেগ পোহাতে হবে না খুব একটা। আর পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত পাওয়ার যোগ্য হবেন এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। সর্বজনীন পেনশন আইনে এমনটা উল্লেখ করা হয়েছে।