অর্থভুবন ডেস্ক
রোজ রাতে লক্ষ্মীপ্যাঁচাদের যুগলবন্দি শুনতে পাই। চলতে থাকে তাদের আবেগভরা হিসহিস, ফিসফিস। একবার টর্চের আলো ফেলে দেখলাম, একটা পাইপের ওপর বসে আছে দুজন। তারুণ্যে ভরা চমকিত দুটি মুখ।
হঠাৎ আলোয় বিচলিত হলেও বিরক্তি নেই চার চোখে। টর্চের আলো নিভিয়ে দিলে অন্ধকারে ডুবে গেল সব। ওরা বসেই রইল। শুধু হিসহিস, ফিসফিস বন্ধ ছিল, যতক্ষণ আমরা ছিলাম।
আমরা আড়ালে গেলেই শুরু হলো ওদের ডাকাডাকি আর ওড়াউড়ি। এই লক্ষ্মীপ্যাঁচা জুটি কিছুদিন ধরে আমাদের প্রতিবেশী। সারি দেওয়া অট্টালিকার ফাঁকফোকরে কোথায় যেন ওরা লুকিয়ে থাকে সারা দিন; নিশুতিরাতে এসে বসে ছাদে কিংবা বারান্দায়। ওদের নজর থাকে নর্দমার ইঁদুর ও ছুঁচোর দিকে।
একেক সময় হঠাৎ নেমে গিয়ে একটি ইঁদুর কিংবা ছুঁচো ধরে নিয়ে ফিরে আসে ছাদে। তারপর তাকে আস্ত গিলে ফেলে।
একদিন দেখি, পুরুষ পাখিটি ইঁদুর মুখে নিয়ে নিশ্চল বসে আছে। পরক্ষণেই মেয়েটি উড়ে এসে তার মুখ থেকে ইঁদুরটি নিয়ে গিলতে শুরু করল। বুঝলাম, প্রণয়ের কাল সমাগত।
প্রজনন মৌসুমে লক্ষ্মীপ্যাঁচার পুরো পরিবারের আহার জোগানোটা পুরুষের কাজ। দুটি মাস ধরে স্ত্রী পাখি একনাগাড়ে ডিমে বসে থাকে আর ছানা ফুটলে সঙ্গ দেয়। সে সময় পুরুষ পাখিটি সারা রাত একাকী শিকার করে স্ত্রী ও ছানাদের ইঁদুর ইত্যাদি দিয়ে যায়। হেমন্ত ওদের প্রজননকাল। তাই শরতেই শুরু পূর্বরাগ, উষ্ণ আলাপ।
লক্ষ্মীপ্যাঁচার প্রণয় কিন্তু স্বল্পমেয়াদি কোনো মৌসুমি মাস্তি নয়। ওদের ভালোবাসা সারা জীবনের। জীবনে ওরা জোড়া ভাঙে না। অমন প্রেম পশুপাখির গোটা জগতেই অতি বিরল। আমৃত্যু বিশ্বস্ত থাকার এই ক্যাথলিক শপথের কথা প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ সম্ভবত জানতেন। তিনি ওদের বলেছেন ‘লক্ষ্মী পাখি’। ‘প্যাঁচা’কে তিনি লিখতেন ‘পেঁচা’। ওদের প্রেমাতুর হিসহিস ধ্বনি শুনে নিশ্চয়ই তিনি লিখেছিলেন :
লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
পক্ষিকুলের এই একনিষ্ঠ প্রেমিক-প্রেমিকার পৃথিবী জয়ের সোনার স্বপ্নসাধ আসলেই পূরণ হয়েছে। বিশ্বের যে ছয়টি মহাদেশে মানুষ বাস করে তার সব কটিতেই লক্ষ্মীপ্যাঁচার বসতি রয়েছে। আর তারা লোকালয়ে বাস করা বড় পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। পাখিবিদরা লক্ষ্মীপ্যাঁচাকে ‘শঙ্কামুক্ত’ আখ্যা দিয়েছেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঝড়ের বেগে পরিবেশ-প্রকৃতি বদলে যাওয়া আমাদের এই দেশটিতেও ওরা ভালোই আছে।
জানিনে লক্ষ্মীপ্যাঁচার বহাল তবিয়তে থাকার এই অসামান্য সাফল্যে তাদের প্রেমময় জীবনযাত্রার অবদান কতটা। পণ্ডিতরা বলেন, প্রাণীর যে প্রত্যঙ্গ ও আচরণ তার বংশবিস্তারে সহায়ক বিবর্তনের স্রোতে তা-ই টিকে থাকে। লক্ষ্মীপ্যাঁচা পাখির আমৃত্যু প্রণয়নিষ্ঠা লাখ লাখ বছর ধরে টিকে আছে। যেমন টিকে আছে হাজারো অন্য প্রজাতির পাখির ক্ষণস্থায়ী প্রেম এবং টিকে আছে স্ত্রী-রাঙ্গাচ্যাগা ও পুরুষ-বাবুই পাখির বহুগামিতা। নানা জাতের পাখির প্রণয়ের ফর্মুলাও নানা রকম।
তবে লক্ষ্মীপ্যাঁচাদের অন্তত সাম্প্রতিক সাফল্যে সম্ভবত ইঁদুর-ছুঁচোর বাড়বাড়ন্তই বড় অবদান রেখেছে। গত এক কোটি বছরে বিশ্বে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট তাবৎ পরিবর্তনের সঙ্গে ইঁদুর খুব ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। বৃক্ষের বন থেকে ঘাসের বনে এবং ঘাসবন থেকে লোকালয়ে গিয়ে ধাপে ধাপে ইঁদুর-ছুঁচোদের অতুলনীয় শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। এদের বিস্তারের পিছেপিছেই বিস্তার লাভ করেছে লক্ষ্মীপ্যাঁচার বসতি।
অনেক দেশে, বিশেষ করে দ্বীপদেশগুলোতে ইঁদুরের অনিয়ন্ত্রিত বংশবিস্তারকে ‘বিস্ফোরণ’ বলা হয়। সেখানে লক্ষ্মীপ্যাঁচার কদরও কিছুটা বেশি। সেখানে অনেক কৃষকই ফসলের ক্ষেতে লক্ষ্মীপ্যাঁচাদের বাসা করার জন্য কাঠের বাক্স স্থাপন করেন। প্যাঁচার জন্য বাক্স বসানোর চমৎকার একটি প্রকল্প আছে জর্দান, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে। সেই প্রকল্পের নাম ‘প্যাঁচার সীমান্ত নেই’।
মানুষ যেমন সীমান্ত দিয়ে বাঁধা, তার প্রণয়ও নানা শর্তে সীমিত। ওদিকে লক্ষ্মীপ্যাঁচার প্রণয় চিরস্থায়ী এবং সম্ভবত শর্তহীন। প্রজননে ব্যর্থ এক জোড়া লক্ষ্মীপ্যাঁচা আমরা কয়েক বছর ধরে সাভারে দেখেছি। ওদের বাসাটা ডিমে ভর্তি থাকত, কিন্তু ডিম থেকে কোনো ছানা হতো না। একটি ডিমও না ফুটলে অন্য পাখিরা সচরাচর জোড়া ভেঙে ফেলে নতুন জোড়া বাঁধে। সাভারের সেই লক্ষ্মীপ্যাঁচা জুটি কিন্তু তা করেনি।
প্রাচীনকালে এ দেশের লোক প্রেমময়ী এই লক্ষ্মীপ্যাঁচাকে পূজনীয় মনে করত। তাদের কাছে সে ছিল লক্ষ্মীর দূত। লক্ষ্মী হলেন সম্পদ, সৌভাগ্য ও শান্তির দেবী। অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীর ঘরেই ভাদ্র, পৌষ ও চৈত্রসংক্রান্তিতে লক্ষ্মীর পুজো হয়। হিন্দু প্রতিবেশীদের বাড়িতে সেই পুজো দেখার শৈশবস্মৃতি মনে করিয়ে দিতেই কি এই ভাদ্রসংক্রান্তিতে লক্ষ্মীপ্যাঁচারা আমার বারান্দায় এসে যুগলবন্দি গাইছে! হয়তো বলছে, জীবন কী সুন্দর!
জানিনে এই লক্ষ্মীপ্যাঁচা যুগলের বয়স কত। জানিনে ওদের জীবনের আর কটা দিন অবশিষ্ট আছে। পরিসংখ্যান বলে, দু-একটি বেশি বুড়ো লক্ষ্মীপ্যাঁচার বয়স ১৫ বছর হলেও ওদের গড় আয়ু পাঁচ বছরেরও কম! পাঁচ বছরের জীবন? এইটুকু জীবনে বিরাগ, বিভেদ আর বিচ্ছেদের সময় কোথায়! আমাদের গড় আয়ু লক্ষ্মীপ্যাঁচার চেয়ে ১৫ গুণ বড়! তাই বুঝি আমাদের জীবন গিঁটে গিঁটে মোচড় খেয়ে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে!
সেদিন বারান্দায় লক্ষ্মীপ্যাঁচারা হিসহিস, ফিসফিস করেই যাচ্ছিল। ঘরের বাতি নিভিয়ে পর্দা সরিয়ে দেখি, চাঁদের মোলায়েম আলোয় ওরা বসে আছে যেন দুটি সাদা মৃন্ময়মূর্তি। চাঁদনি রাতে গাছের মগডালে গিয়ে এমন করেই লক্ষ্মীপ্যাঁচারা বসে থাকত, যখন পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব হয়নি। আজ এখানে গাছ সরিয়ে আমরা লোহালক্কড় আর কংক্রিট জড়ো করেছি। কিন্তু চাঁদের আলো তো আগের মতোই আছে। তাই হয়তো আজও জেগে আছে লক্ষ্মীপ্যাঁচাদের সেই আমৃত্যু প্রেম।