ঢাকা ওয়াসার পানি বিষাক্ত, পানের অযোগ্য। তাই খুব ভালো করে ফুটিয়ে এই পানি পান করে নগরবাসী। টিআইবি বলছে, রাজধানীর ৯১ শতাংশ মানুষ পানি ফুটিয়ে পান করে। এ ছাড়া সারা দেশে যারা সাপ্লাইয়ের পানি ব্যবহার করে তারাও পানি ফুটিয়ে পান করে। এই পানি ফোটাতে সারা দেশে প্রতিদিন প্রায় শতকোটি টাকার গ্যাস পোড়াতে হয়। তিতাত গ্যাসের আওতাধীন এলাকায় পানি ফোটাতে প্রতিদিন খরচ হয় প্রায় ৮৬ লাখ টাকার গ্যাস। এ হিসাব শুধু যারা বিতরণ কোম্পানির গ্যাস ব্যবহার করে তাদের। যারা এলপিজি ব্যবহার করে পানি ফুটিয়ে পান করে এবং লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ নিয়ে গ্যাস ব্যবহারকারীদের হিসাবে ধরলে গ্যাস খরচের হিসাব আরও বড় হবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং নানা পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিআইরসি) ও তিতাস গ্যাসের তথ্য অনুযায়ী, আবাসিকের ২ চুলার একজন গ্রাহক গড়ে প্রতি মাসে ৬০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করে। এর জন্য তাকে বিল দিতে হয় ১০৮০ টাকা। সে হিসাবে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়ে ১৮ টাকা। গড়ে ৬ ঘণ্টা চুলা জ্বালায় একজন গ্রাহক। এর মধ্যে পানি ফোটানোর জন্য গড়ে আধাঘণ্টা চুলা জ্বালাতে হয়।
পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির গ্রাহকসংখ্যা ৪৩ লাখ। আবাসিক গ্রাহক ৩৭ লাখের মধ্যে প্রিপেইড গ্রাহক ৩ লাখ। তিতাসের তথ্য অনুযায়ী, তাদের আবাসিক গ্রাহক ২৮ লাখ ৭৬ হাজার।
সব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিদিন আধাঘণ্টা চুলা জ্বালাতে কম-বেশি ৩ টাকার গ্যাস খরচ হয়। সে হিসাব ধরলে ৬টি বিতরণ কোম্পানির ৩৭ লাখ গ্রাহক প্রতিদিন ১১১ কোটি টাকার গ্যাস পোড়াচ্ছে। আর তিতাস গ্যাসের ২৮ লাখ ৭৬ হাজার গ্রাহক পোড়াচ্ছে ৮৬ লাখ টাকার গ্যাস। বছরে ৩৭ লাখ গ্রাহক শুধু পানি ফোটাতেই খরচ করছে ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার গ্যাস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সিস্টেম লস, চুরিসহ নানাভাবে গ্যাস অপচয় হচ্ছে। ওয়াসার সরবরাহ করা পানি পানযোগ্য হলে পানি ফোটানোর দরকার পড়ত না। গ্যাসের অপচয়ও হতো না। রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। বেঁচে যাওয়া গ্যাস অন্য খাতে ব্যবহার করা সম্ভব হতো।
ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম-দুর্নীতি ও গ্রাহকসেবার বিভিন্ন ঘাটতির দিক নিয়ে ২০১৯ সালে ‘ঢাকা ওয়াসা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি। তাতে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসা
পাইপলাইনের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহে ব্যর্থ। ৯১ শতাংশ গ্রাহক পানি ফুটিয়ে পান করে। ওয়াসা যদি পানের উপযোগী পানি সরবরাহ করত, তা হলে এত বিপুল অর্থের গ্যাস সাশ্রয় হতো। পানি ফোটাতে দীর্ঘ সময় চুলা জ্বালানো ছাড়াও কাপড় শুকানো বা ম্যাচের কাঠি বাঁচাতে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখে অনেকে।
রাজধানী বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা রান্না এবং পানি ফোটানোর গ্যাসের চুলা জ্বালায়। এক পাতিল পানি ফোটাতে কমপক্ষে আধাঘণ্টা সময় লাগে। যাদের পরিবারে সদস্যসংখ্যা বেশি তাদের বেশি পানি ফোটাতে হয়। এতে সময়ও বেশি লাগে।
মিরপুর-১-এর বাসিন্দা মিমি জানান, তারা ফোটানো ছাড়া পানি পান করেন না। গ্যাসের চুলায় ১ পাতিল পানি ফোটাতে কমপক্ষে আধাঘণ্টা লাগে। গ্যাসের চাপ কম থাকলে সময় বেশি লাগে। এলপিজিতে ফোটাতে ১ ঘণ্টা সময় লাগে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, চলতি বছরের জানুয়াারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৯৯টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অবৈধ সংযোগ ও বকেয়ার জন্য ২ লাখ ২৩ হাজার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। গ্যাসের অপচয় রোধে জনসচেতনতা তৈরির জন্য নানা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ বলেন, অনেকেই একটি ম্যাচের কঠি অপচয় বা পানি ফোটানোর জন্য চুলা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বালিয়ে রাখে। দেখা গেছে, গ্যাসের বেশি অপচয় করে প্রিপেইড মিটারবিহীন গ্রাহকরা। মিটারযুক্ত গ্রাহক প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চুলা জ্বালায় না। এতে গ্রাহকের যেমন সাশ্রয় হচ্ছে, অপচয়ও রোধ হচ্ছে।
এ বিষয়ে ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, প্রথমত সুপেয় পানি সরবরাহ না করার জন্য দায়ী ওয়াসা। নগরবাসী টাকা দিয়েও সুপেয় পানি পাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে ফুটিয়ে পানি পান করতে হচ্ছে। গ্যাসের প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীদের খরচ অনেক কম, তারা অপচয়ও কম করে। সে তুলনায় মিটারবিহীন গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল বেশি নেওয়া হচ্ছে এবং কোনো হিসাব না থাকায় তারা যেমন ইচ্ছা গ্যাস ব্যবহার করছে। এতে অপচয় বেশি হচ্ছে। এটা রোধে সুপেয় পানি সরবরাহ এবং প্রিপেইড মিটার স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
দেশে চাহিদার বিপরীতে দৈনিক প্রায় ৮০০ এমএমসিএফ গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে অবশিষ্ট গ্যাসের মজুদের পরিমাণ প্রায় ১২.৭৪ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট)। স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় এ মজুদ থেকে এখনই চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে না।
জ্বালানি সাশ্রয়, সংরক্ষণ ও জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে ২০১৬ সালে একটি মহাপরিকল্পনা নেয় সরকার। এতে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশ ও ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। গত বছর পর্যন্ত জ্বালানি সাশ্রয়ে মাত্র ৩ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে।