Saturday, December 7, 2024

ডায়াবেটিক সেবা দিবস এবং স্বাস্থ্যসেবায় কর্মীর প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয়

 

৬ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের (১৯১১-১৯৮৯) ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যবার্ষিকীর দিনটিকে সমিতি ডায়াবেটিক সেবা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।

জন রাসকিন তাঁর অর্থনৈতিক দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন  Unto This Last (1860)  বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘অর্থ ও বিত্ত মানুষের সত্যিকারের মূল্যায়ন করে না, মানুষের মূল্যায়ন হয় তার ওপর অন্য মানুষের আস্থার ভিত্তিতে।

 
’ রাসকিন উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, ‘মনে করা যাক, একটি লোক কোটি কোটি টাকা আয়ত্ত করে এক বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন, যাঁর টেবিল সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো, আর তাঁর বাড়ির চারদিকে বিলাসবৈভবের ছড়াছড়ি। কিন্তু ঘটনাচক্রে তাঁকে এমন একটি স্থানে আশ্রয় নিতে হলো, যেখানে তিনি ব্যতিরেকে অন্য কোনো দ্বিতীয় জনমানব নেই। কাজেই স্বাভাবিকভাবে তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজন তাঁর নিজেকেই মেটাতে হবে, নিজের রান্না নিজের রেঁধে খেতে হবে। পরিধেয় বস্ত্র তাঁকে ধুতে হবে, এমনকি সামান্য একটু সান্ত্বনা পাওয়ার জন্যও অন্য কোনো মানুষের ছায়াও তাঁর আয়ত্তের বাইরে।
 
সে ক্ষেত্রে তাঁকে কি বড়লোক বা ধনী বলা যাবে? থাকুক না তাঁর অগণন টাকার পাহাড়। একজন লোক ধনী কী নির্ধন সেটা নির্ধারিত হওয়া উচিত সেই লোকটির প্রতি অন্য কতজন লোকের আস্থা রয়েছে, সেটার ভিত্তিতে। যাঁকে দেখলে মানুষ আনন্দে হেসে উঠবে। মনে করবে তাঁদের পরম হিতৈষী চলে এসেছেন, এবার সব সমস্যার সমাধান করে তাঁদের দুশ্চিন্তা মুক্ত করবেন তিনি।
 
তাঁকে দেখামাত্রই সবাই উল্লসিত মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথ ছেড়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ মানুষের ভালোবাসা, সহযোগিতা এবং অবস্থাই ধনী-নির্ধন পার্থক্যের মাপকাঠি।’ ডাক্তার ইব্রাহিম ঠিক এই ধাঁচে তাঁর সমগ্র কর্মজীবন গড়ে নিয়েছিলেন।

 

রাসকিনের ভাবদর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তো বটেই, বিশ্বব্যাপী মহাত্মা নামে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন এবং খ্যাতি অর্জন করেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। গান্ধীজি ১৯০৮ সালে গুজরাটি ভাষায় সর্বোদয়া শিরোনামে  Unto This Last-এর ভাবানুবাদ করেন।

 
  ডা. ইব্রাহিম গান্ধীজির নিম্নোক্ত ধ্যান-ধারণাকে তাঁর চিন্তা-চেতনার চৌহদ্দিতে ঠাঁই দিয়েছিলেন— ‘কেউ যদি সর্বব্যাপী বিস্তৃত চিরন্তন সত্যের মহত্ত্বকে নিজের সম্মুখে বাস্তবে দেখতে চান, তাহলে স্রষ্টার সর্বনিম্ন সৃষ্টিকে নিজের মতো করে ভালোবাসার যোগ্যতা তাঁর মধ্যে থাকতে হবে এবং এরূপ কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি এরপর জীবনের কোনো ক্ষেত্র থেকেই নিজেকে আলাদা করে রাখতে পারবেন না। তাই সত্যের প্রতি এরূপ একাত্মতা আমাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে নিয়ে এসেছে, এবং আমি কোনোরূপ দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে বলা যায় সম্পূর্ণ বিনয়ের সঙ্গে বলছি যে যাঁরা বলে রাজনীতিতে ধর্মের কোনো কিছুই করার নেই, ধর্ম কী বলছে তা তাঁরা জানেন না।’

 

সব ঐশী গ্রন্থ ও নীতিশাস্ত্রে অসুস্থ মানুষ বা প্রাণীকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব পালনের জন্য চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন উদ্ভব এবং অধ্যয়ন শেষে তাঁদের একটি প্রতিজ্ঞাপত্র বা প্রত্যয় বাণী উচ্চারণ করতে হয়, যার মধ্যে সেবাকে আদর্শ হিসেবে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। হিপোক্রিটাস চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি গুরু। প্রায় পৌনে তিন হাজার বছর আগে তাঁর জন্ম। একবার শিষ্যদের গাছতলায় জড়ো করে তিনি একটি শপথবাক্য পাঠ করান। শপথবাক্যটি ছিল, ‘অতঃপর আমি শপথ গ্রহণ করছি যে জেনেশুনে এবং ধর্মত রোগীর ক্ষতি হয় এমন কোনো ওষুধ দেব না। শত্রু-মিত্রভেদে সব রোগীকে সমান মন-প্রাণ দিয়ে চিকিৎসা করব এবং তার মানসিক দুশ্চিন্তা লঘু করার জন্য সব সময় ভরসা দেব।’ হিপোক্রিটাস শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন এ জন্য যে ডাক্তার হলেও প্রত্যেকেই মানুষ এবং মানুষ মাত্রই হিংসা-দোষ আছে। এসবের বশবর্তী হয়ে  চিকিৎসা করতে গেলে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। তা যাতে না হয়, এই ছিল শপথবাক্য পাঠ করানোর মূল দর্শন। পৌনে তিন হাজার বছরে পৃথিবীর চেহারার বহু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শপথবাক্যটি আছে। আর আছে বলেই পৃথিবীর দেশে দেশে সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় ডাক্তারদের ওই শপথবাক্য

 (I WILL maintain the utmost respect for human life; even under threat, I will not use my medical knowledge contrary to the laws of humanity. I MAKE these promises solemnly, freely and upon my honour.)  পাঠ করানো হয়।

চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মী রোগীকে সেবা দেবেন সেই আদর্শ প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতির আলোকে। এখানে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক হবে পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে। রোগী নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করবে চিকিৎসক তার সমস্যা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন এবং তার রোগমুক্তির নিশানা দেবেন। সৃষ্টিকর্তা এটুকুই চান—তুমি তাকে চিকিৎসা দাও, নিরাময় আমি দেব। চিকিৎসাসেবার ভিত্তিতে রোগীকে নিরাময় দেবেন। এই বিষয়গুলো যদি আরো তাৎপর্যগতভাবে বিশ্লেষণে যাওয়া যায়, তাহলে চিকিৎসক রোগীর সম্পর্কের ধরন বা প্রকৃতি বুঝতে কারো কষ্ট হয় না। চিকিৎসক অবশ্যই সহানুভূতিপ্রবণ হবেন রোগীর সমস্যার প্রতি; কিন্তু রোগীর তরফ থেকে ডাক্তারের কাছে প্রত্যাশার বলয় ও ব্যাপ্তিকেও যদি বিবেচনায় না আনা যায়, তাহলে চিকিৎসকের সহানুভূতি-প্রবণতা যথাযথভাবে কার্যকর হবে না। অর্থাৎ রোগী ডাক্তারের কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করছেন, সেটা চিকিৎসক যদি নিজেকে রোগীর জায়গায় কল্পনা ও উপলব্ধির জায়গায় না যান, তাহলে তাঁর পক্ষে সহানুভূতি প্রদর্শন একপেশে হয়ে দাঁড়াবে। অধ্যাপক ইব্রাহিম সহানুভূতিকে অর্থবহ বা কার্যকর করে তুলতে রোগীর জায়গায় নিজেকে অনুভব করেন। এটিই ইমপ্যাথি বা সমানুভূতি। ডায়াবেটিস চিকিৎসার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর গবেষণা ও চর্চার জন্য ফুটপাতে পড়ে থাকা অসহায়, হতদরিদ্র ও চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষকে নিজের গাড়িতে তুলে নিতেন। তাঁর চিকিৎসালয়ে নিয়ে তাকে খাবার দিয়ে, ভালো পোশাক পরিয়ে, তার কাছ থেকে গবেষণার উপাদান নিয়ে পরীক্ষা করতেন। আপাত ওই ব্যক্তির থাকা-খাওয়ার সংস্থান করে তার প্রতি সহানুভূতি পোষণ করা হলো এবং তার কাছ থেকে গবেষণার উপাদান নিয়ে সেটি অনুপুঙ্খ পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসার উপায় অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হলেন এবং সেই উপায় অন্য অনেকের সুস্থতার জন্য প্রয়োগ করলেন—এভাবে বাংলাদেশে ডায়াবেটিক চিকিৎসাব্যবস্থার গণমুখী সমানুভূতিপ্রবণ ব্যবস্থায় উন্নীত করলেন। তাঁর সেই আদর্শ, প্রয়োগ পদ্ধতির সারকথা ছিল—রোগীর সমস্যার প্রতি সমানুভূতিপ্রবণ হতে পারলে রোগীর আস্থা যেমন বাড়বে, রোগী মানসিক শান্তি পাবেন, চিকিৎসক পরোপকারের সামাজিক স্বীকৃতি পাবেন এবং এর দ্বারা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে উভয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় ও উপলক্ষ তৈরি হবে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এবং সদস্য, ন্যাশনাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি

spot_imgspot_img

ছবিটা তুলে রাখুন ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে : ড. ইউনূস

গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগে করা মামলায় জামিন পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।...

মায়ের ঘুমপাড়ানি সুর শান্তিধারা

আমাদের জোনাকজ্বলা গ্রাম বিদ্যুৎ তখনও দেখেনি। সন্ধ্যার কাছে বিকেল নতজানু হতেই সবুজ পাহাড়েরা মিশকালো হয়ে যায়। ফলে- আমরা চালের ফুটো দিয়ে চাঁদ দেখি, আর...

মাহবুবা ফারজানা নতুন তথ্য সচিব

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বেগম মাহবুবা ফারজানা। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ছিলেন। তাকে সচিব পদে পদোন্নতি...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here