ডন সামদানি ফ্যাসিলিটেশন অ্যান্ড কনসালটেন্সির আয়োজনে ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হলো ‘রাইজ অ্যাবাভ অল’। দিনব্যাপী বক্তৃতার এই আয়োজনে অন্যদের পাশাপাশি তরুণদের উদ্দেশে একটি বক্তৃতা দেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের উপাচার্য রুবানা হক। পড়ুন তাঁর বক্তব্যের নির্বাচিত অংশ।
অর্থভুবন ডেস্ক
আমরা প্রত্যেকেই ছুটছি। কিসের পেছনে ছুটছি, জানি না। কেউ শর্টকাটের পেছনে ছুটছি, কেউ সত্যি নিজের অন্তরের আশাকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছি, কেউ একেবারে গন্তব্যহীনভাবে ছুটছি। এই ছোটার কোনো সংজ্ঞা আসলে নেই, এই গতিরও কোনো সংজ্ঞা নেই।
আমি জানি না, (অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের) অ্যালিস ও রেডকুইনের গল্পটা আপনারা জানেন কি না। গল্পের মধ্যে একটা দৃশ্য আছে, সেখানে অ্যালিস আর রেডকুইন সমানে দৌড়াচ্ছে। সঙ্গে জায়গাটাও দৌড়াচ্ছে। ওখানে একটা বড় গাছ আছে, গাছটা নড়ছে না। অনেকক্ষণ পর অ্যালিস ক্লান্ত হয়ে রেডকুইনকে বলছে, ‘রেডকুইন, আমি আর তুমি যে এত দৌড়াচ্ছি, গাছ তো জায়গা বদলাচ্ছে না। কিন্তু আমরা তো দৌড়াচ্ছি ঠিকই।’ তখন রেডকুইন উত্তর দেয়, ‘ইট অনলি মিনস দ্যাট উই আর স্লো’(এর একটাই মানে, আমরা মন্থরগতি)।
তার মানে হলো, অ্যাকটিভিটি (কর্মকাণ্ড) মানেই কিন্তু প্রোগ্রেস (প্রগতি) না। আপনি শুধু দৌড়াচ্ছেন, গন্তব্যহীনভাবে দৌড়ালে কিন্তু সেটাকে প্রগতি বলে না। কাজেই মাথায় রাখতে হবে, দৌড় হতে হবে অর্থবহ। যে দৌড় আপনার জীবনকে সার্থক করবে, শুধু সেই দৌড়ই দৌড়াবেন।
একলা দৌড়ানোও কিন্তু শিখতে হয়। যখন দেখবেন সহযাত্রী আপনার সঙ্গে দৌড়াতে পারছে না, একটুও পিছু হটবেন না। কারণ, একা দৌড়ানোর মধ্যে একটা বড় সার্থকতা আছে।
পক্ষপাত ঝেড়ে ফেলুন
নিজের জীবনে, নিজের মাথায় যত পক্ষপাত আছে, সব ঝেড়ে ফেলুন। একদম ধুয়েমুছে সাফ করে দিন। কারণ, পক্ষপাত আসলে আমাদের সমাজকে খেয়ে ফেলছে। আপনি নিজেও জানেন না যে আপনি কতখানি পক্ষপাতদুষ্ট।
একটা পরিসংখ্যান বলে, ১ সেকেন্ডে আমরা ৪০টা জিনিস মাথায় রাখতে পারি। তবে অচেতনে, অবচেতনে প্রায় ১ কোটি ১ লাখ তথ্য আমাদের মাথায় ঢোকে। এর অর্থ, আমরা নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছি। হয় আমাদের পারিপার্শ্বিকতা আমাদের প্রভাবিত করছে, অথবা আমার সন্তান আমাকে প্রভাবিত করছে, অথবা সমাজ প্রভাবিত করছে। এই প্রভাবিত হওয়ার সময় ভুলে গেলে চলবে না যে পক্ষপাতিত্ব একটা বড় দোষ।
কত রকম পক্ষপাতিত্ব হয়, তার ছোট ছোট উদাহরণ দিই। কয়েক দিন আগেই খুলনার এক জায়গায় চারটা মেয়ে ফুটবল খেলছিলেন। মানে, অন্যদের সঙ্গে ফুটবল খেলছিলেন। কিন্তু তাঁরা হাফপ্যান্ট পরে ছিলেন। এই জন্য মেয়েগুলোকে যে কত কটূক্তি শুনতে হয়েছে! তাঁদের থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, বহু কিছু করা হয়েছে। একটি কারণে শুধু, সেটি হলো তাঁদের কাপড়। আপনি কী পরবেন, সেটাও যদি প্রতিদিন কেউ খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে, আপনার সমালোচনা করে—এটা কিন্তু সমাজের জন্য অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত।
চিন্তা করেন, এত কিছুর পরও আজকে মেয়েরা এত এগিয়ে গেছে, কিন্তু পক্ষপাতে মেয়েরা পেছনে। ইউএনডিপির একটা খুব সাম্প্রতিক জরিপ বেরিয়েছে। বিশ্বের শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে, পুরুষেরা রাজনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত ভালো নেতা হতে পারেন, নারী নন। শতকরা ৪০ ভাগ লোক মনে করে, ব্যবসার নির্বাহী পদে একজন নারীর তুলনায় একজন পুরুষ ভালো কাজ করবেন। এর চেয়েও একটা লোমহর্ষক তথ্য আছে। সেটা বলে, শতকরা ২৮ ভাগ মানুষ মনে করে, সে তার বউকে পেটাতে পারে। এই হলো সমাজের অবস্থা। কাজেই এত পক্ষপাতদুষ্ট সমাজকে যদি আপনি ঠিক করতে যান, তাহলে আপনাকে সব পক্ষপাত ছাপিয়ে যেতে হবে।
মধ্যবিত্তের শক্তি
অনেক ধরনের পক্ষপাত আমাদের ঘিরে থাকে। কেউ গরিব হলে আমরা তাকে অন্য চোখে দেখি। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করি, সেখানে ১ হাজার ৭০০ শিশু ১৭টা দেশ থেকে আসে এবং প্রত্যেকে প্রায় সুবিধাবঞ্চিত। আমি কাজ করে আনন্দ পাই। কারণ, সম্ভাবনার জায়গা আসলে দারিদ্র্যের জায়গা। সম্ভাবনার জায়গা কিন্তু বিত্তের জায়গা নয়। বিত্ত আমাদের অনেকগুলো জায়গা খুলে দেয়। অনেকগুলো সুযোগ দেয়।
একটু খেয়াল করে দেখেন, এই মধ্যবিত্তের উত্থান কিন্তু বাংলাদেশে কেউ ঠেকাতে পারেনি। কাজেই মনে রাখতে হবে, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মধ্যবিত্ত, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায় আজ আমার সামনে যাঁরা বসে আছেন, এই তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণ প্রজন্মকে আসলে বিশেষ কিছু বলার নেই। শুধু এটাই বলব, আপনাদের কাছে আমাদের অনেক আশা।
আমরা যাঁরা এখন অনেক পরিপক্ব, মাথা অনেক পেকে গেছে, আমরা সবাই মনে করি, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এগোনোটা আপনাদের দায়িত্ব। সবাইকে পাশে রেখে, সবার জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য হোক আপনার যাত্রা—এটাই আমরা আশা করি। মনে রাখবেন, কেন সময় এত জরুরি আপনাদের জন্য। একটা খুব সুন্দর কবিতা আছে— ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ কারণ, উত্তম সময়টা বয়ে যাচ্ছে। হেলাল হাফিজের এই কবিতা মনে রাখবেন। আসলে সময় চলে যায়, এই সময়ের হাত ধরে হাঁটতে গেলে আপনার সময়কে অতিক্রম করতে হবে। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। (সংক্ষেপিত ও ঈষৎ পরিমার্জিত)