অর্থভুবন প্রতিবেদক
তিন বছর ধরে দেশে নতুন পেট্রলপাম্প স্থাপনের অনুমোদন বন্ধ ছিল। হঠাৎ করে সেই আদেশ তুলে নিয়ে এক সচিব, দুই সাংসদ আর চার মন্ত্রীর সুপারিশে সাতটি পাম্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপরই আবার চিঠি দিয়ে নতুন পাম্পের অনুমোদন বন্ধ রাখতে বলে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এই ফাঁকে যাঁরা পাম্পের অনুমোদন পেলেন, তাঁরা সুপারিশকারীদের আত্মীয়স্বজন বা ঘনিষ্ঠজন।
এভাবে পাম্পের অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আনিছুর রহমান অর্থভুবনকে বলেন, ‘সবাই যে তদবির করে অনুমোদন পেয়েছেন, তা নয়। দূরত্ব, অবস্থা, তেলের চাহিদা, যানবাহনের সংখ্যা বিবেচনা করেই পাম্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তদবিরে সব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে–যাঁরা বলছেন তাঁরা হয়তো আবেদন করে অনুমোদন পাননি বলে এসব বলছেন।’
এদিকে পাম্প স্থাপনের অনুমতি চেয়ে করা শতাধিক আবেদন তিন বছর ধরে চট্টগ্রামের বিপিসি দপ্তরে পড়ে আছে। এর মধ্যে ৩৯টি প্রস্তাবে জ্বালানি তেল বিপণন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের সভায় অনুমোদনও পেয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির কারণে নতুন পাম্প স্থাপনের অনুমতি দিতে পারছে না বিপিসি।
এ সমস্যা নিয়েও কথা বলেছেন জ্বালানিসচিব। তিনি বলেন, ‘কিছু আবেদন ঝুলে আছে। এগুলো নিষ্পত্তিতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা কমিটি করে দিয়েছি। তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে কোম্পানির প্রতিবেদনের সত্যতা নিরূপণ করে দেবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে এই কমিটি আমাদের কাছে প্রতিবেদন দেবে। এরপর আমরা ব্যবস্থা নেব।’
২০১৪ সালের ফিলিং স্টেশন (পেট্রলপাম্প) স্থাপন নীতিমালা অনুযায়ী নতুন পাম্প স্থাপনে অনুমোদনের এখতিয়ার বিপিসির। এ জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের দরকার হয়নি কখনো। এখন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পরই নীতিমালা অনুযায়ী বিপিসি ও এর অধিভুক্ত তিন রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণন কোম্পানি পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানি পাম্পের অনুমোদন দিচ্ছে।
বিশেষ বিবেচনায় যে সাতটি পাম্প অনুমোদন পেয়েছে, সেগুলো হলো রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকায় মেসার্স টোটাল সিএনজি লিমিটেড, ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে দোলেশ্বর ফিলিং স্টেশন, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে ধনবাড়ী ফিলিং স্টেশন, চট্টগ্রামের রাউজানে মেসার্স রাউজান ফিলিং স্টেশন, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে এম আই ফিলিং স্টেশন, ভোলার চরফ্যাশনে এন মোহাম্মদ ফিলিং স্টেশন এবং চাঁদপুরের বাবুরহাটে শারমিন ফিলিং স্টেশন।
সূত্রমতে, মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের ২১ জুন এক দাপ্তরিক আদেশে নতুন পাম্পের অনুমোদন বন্ধ রাখতে বলে বিপিসিকে। দ্বিতীয় পত্রটি দেয় ২০১৯ সালের ২৪ জুন। দুটি পত্রেই বিশেষ ক্ষেত্রে একান্ত আবশ্যক বিবেচিত হলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের অনুমতি নিয়ে ফিলিং স্টেশন স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। দুটি পত্রই দেওয়ার সময় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তাঁর মেয়াদে আর কোনো নতুন পেট্রলপাম্প অনুমোদন পায়নি। বর্তমান জ্বালানিসচিবের সময়ে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও সাত পেট্রলপাম্প অনুমোদনের জন্য চিঠি দেওয়া হয় বিপিসিকে, যা দ্রুত কার্যকর করা হয়।
অর্থভুবনের প্রতিনিধিরা এলাকা ঘুরে দেখেছেন, এই সাত পাম্পের মধ্যে চাঁদপুর, মাতুয়াইল ও চরফ্যাশনের পাম্প তিনটিতে জ্বালানি তেল বিক্রি চলছে। অপর তিনটির অবকাঠামো আর মাটি ভরাটের কাজ চলছে। চট্টগ্রামের রাউজানে পাম্পটির অস্তিত্ব এখনো কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ।
চাঁদপুর জেলা পরিষদ অফিসের উল্টো পাশে মেসার্স শারমিন ফিলিং স্টেশনের অবস্থান। এই পাম্পে পেট্রল, অকটেনসহ সব ধরনের জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এই পাম্পটি স্থাপনে প্রথম তদবির ছিল আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার। পরে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিবের প্রচেষ্টায় পাম্পটি অনুমোদন পায়। পাম্পটির মালিক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা (জেলা কমিটির সাবেক সদস্য)। মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আনিছুর রহমানের প্রয়াত শ্বশুর এলাকার সাবেক সাংসদ ছিলেন।
যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিশেষ বিবেচনায় ফিলিং স্টেশন পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে এতে জ্যেষ্ঠ সচিব আনিছুর রহমানের কোনো প্রভাব নয়, যমুনা অয়েল কোম্পানি ও বিপিসি অনুমোদন দেয় বলে দাবি করেন তিনি।
পাম্পটির অনুমোদনের সময় বিপিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন সদ্য অবসরে যাওয়া সরকারের সচিব শামসুর রহমান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই পেট্রলপাম্পের অনুমোদনের বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নথিতে দেখা যায়, চট্টগ্রামের রাউজানের ‘মেসার্স রাউজান ফিলিং স্টেশন’ স্থাপনের জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয় অনাপত্তিপত্র দেয় গত ২১ মে। স্থানীয় সরকারদলীয় সাংসদ এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর আধা সরকারি পত্র (ডিও) ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় এই পত্র দেয়। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাংসদপুত্র ফারাজ করিম চৌধুরী। মেঘনা পেট্রোলিয়ামে দেওয়া আবেদনপত্রে ফারাজ করিম চৌধুরীর যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তাঁর বাবার ফোন নম্বরে বারবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। রাউজানে খোঁজ নিয়ে কোথাও এই পেট্রলপাম্পের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
একইভাবে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর আধা সরকারি পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে এম আই ফিলিং স্টেশন অনুমোদন দেওয়া হয় গত ৩ জানুয়ারি। এটির মালিকানা যৌথভাবে আওয়ামী লীগ নেতা ইসহাক আলী ও মাহবুবুর রহমান।
বোচাগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সফিকুল আলম জানান, ইসহাক আলী আগে সেতাবগঞ্জ পৌর বিএনপির প্রচার সম্পাদক এবং মাহবুবুর রহমান সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তাঁরা আওয়ামী লীগে যান।
জানতে চাইলে ইসহাক আলী অর্থভুবনকে বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সুপারিশ ছিল, তাই অনুমোদন পেয়েছি।’ প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো বোন তাঁর স্ত্রী বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকারের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষের জীবন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। বেড়েছে জ্বালানির চাহিদা। আমার এলাকায় চাহিদা আছে দেখেই আমি ডিও দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে।’
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে দেওয়া কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের চাহিদাপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে ধনবাড়ী ফিলিং স্টেশন অনুমোদন দেওয়া হয় গত ১৮ মে। টাঙ্গাইল-জামালপুর মহাসড়কের পাশে এই পাম্পের অবস্থান। এটির মালিকানায় আছেন হোসনে আরা বিনা নামের এক নারী উদ্যোক্তা।
সাংসদ তোফায়েল আহমেদের সুপারিশে ভোলার চরফ্যাশনে এন মোহাম্মদ ফিলিং স্টেশন অনুমোদন পায়। ফিলিং স্টেশনটি উপজেলার বাস টার্মিনালের উত্তর পাশে। এটির মালিক নূরে আলম শিকদার, যিনি চরফ্যাশন উপজেলার এওয়াজপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান।
নূরে আলম শিকদার অর্থভুবনকে বলেন, ‘অনেক কষ্ট পেয়েছি এই পাম্পের অনুমোদন পেতে। শেষমেশ কাকার (তোফায়েল আহমেদ) সুপারিশে পেয়েছি।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সুপারিশে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকায় স্থাপিত হয়েছে মেসার্স টোটাল সিএনজি লিমিটেড। এই পাম্প পুরোদমে চালু আছে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে দোলেশ্বর ফিলিং স্টেশন হয় জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সুপারিশে। এর মালিক আবুল হোসেন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে এলাকায় পরিচিত। পাম্প স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। মালিক আবুল হোসেন অর্থভুবনকে বলেন, ‘মন্ত্রী আমার প্রতিবেশী। তাঁর সুপারিশেই পেয়েছি।’
ছয়টি পেট্রলপাম্পের অনুমোদনের সময় বিপিসির চেয়ারম্যান ছিলেন বর্তমান সেতুসচিব আবু বকর ছিদ্দীক। তিনি অর্থভুবনকে বলেন, পেট্রলপাম্পের অনুমোদনের নির্দেশ মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে, তাই বিপিসি থেকে বাধা দেওয়া হয়নি।
বিপিসির পেট্রলপাম্পের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা আটকে রেখে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিশেষ বিবেচনায় অনুমোদনের সমালোচনা করে জ্বালানি খাতবিষয়ক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নীতিনির্ধারণের। সেই মন্ত্রণালয়ই যদি তার অধীনস্থদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে এবং অনিয়মের চর্চা করতে বাধ্য করে, তাহলে সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
বর্তমানে দেশে মোট পেট্রলপাম্পের সংখ্যা ২ হাজার ২৬৭টি। যার মধ্যে পদ্মা অয়েলের আওতায় ৭০২টি, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের আওতায় ৮২৬টি এবং যমুনা অয়েলের আওতায় ৭৩৯টি পেট্রলপাম্প রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের এই তিনটি তেল বিপণন কোম্পানি নিজ নিজ অধিভুক্ত পাম্পে জ্বালানি তেল সরবরাহ করে, যা সরকার-নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়।