আরবি বছরের দ্বিতীয় মাস সফর। একাদশ হিজরির সফর মাসে আল্লাহর প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মাদ (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারছিলেন প্রিয়তমের সমীপে শেষ আহ্বান।
তিনি উম্মুল মুমেনিন হজরত জয়নব (রা.)-এর গৃহে অবস্থান করছিলেন। ক্রমে জ্বর ও মাথাব্যথার তীব্রতা বাড়ায় তার সর্ব কনিষ্ঠ প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত আয়েশা (রা.)-এর গৃহে তাশরিফ নিলেন। অসুস্থ থাকাকালীন খায়বারের ইহুদিনী কর্তৃক বিষ প্রয়োগের কথা উল্লেখ করছিলেন।
এমতাবস্থায় রুগ্ণ শরীর নিয়ে মসজিদে নববিতে উপস্থিত হয়ে ইমামতি করছিলেন। অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলে হজরত আবু বকর (রা.)কে ইমামতি করতে আদেশ দেন। আর বললেন, তিনি রোগ যন্ত্রণায় কাতর এবং পরদিন নামাজে শরিক নাও হতে পারেন।
তাই তিনি বললেন, কোনো পাওনাদার থাকলে সে যেন দাবি করে। এক ইহুদি উপস্থিত হয়ে তিন দেরহাম দাবি করলে তৎক্ষণাৎ তা প্রদান করা হলো। তার অসুস্থতায় ইহুদি ও মুনাফেকদের আনন্দের সীমা রইল না। অপরদিকে মুসলমানদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যেতে লাগল। রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে রাসূল (সা.) জান্নাতুল বাকি কবরস্থান জিয়ারতে গিয়ে সব কবরবাসীর জন্য এবং পৃথিবীবাসীদের বিভ্রান্ত পথ থেকে সরে আসার জন্য দোয়া করেছিলেন। এরপর থেকেই তাঁর মাথাব্যথা ও জ্বর শুরু হয়েছিল।
আরবি আর ফারসি ভাষার সংমিশ্রণে আখেরি চাহার শোম্বা অর্থাৎ মাসের শেষ বুধবার। সফর মাসের শেষ বুধবার রাসূল (সা.) বেশ সুস্থতা বোধ করেছিলেন এবং গোসল করেছিলেন। তার রোগ মুক্তির খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সাহাবারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়া আদায়ে লেগে পড়লেন। শোকরানার নাজাম, প্রার্থনা ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে। কেউ দাস মুক্ত করে দিলেন, অনেকে অর্থ অথবা উট বিলিয়ে দিলেন। হজরত আবু বকর (রা.) পাঁচ হাজার দিরহাম, হজরত ওমর (রা.) ৭ হাজার দিরহাম, হজরত ওসমান (রা.) দশ হাজার দিরহাম, হজরত আলী (রা.) তিন হাজার দিরহাম, হজরত ইবনে আউফ (রা.) একশ উট দান করেন গরিব সাহাবিদের মাঝে।
এভাবে অন্য সাহাবারা যার যা সামর্থ্য অনুযায়ী দানের মাধ্যমে আনন্দ উদযাপন করেন। রাসূল (সা.)-এর সুস্থতায় সবার মাঝে আনন্দের জোয়ার নেমে এসেছিল। সেই থেকে আজ অবধি মুসলিম বিশ্ব যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালন করে আসছে। এই দিনে সাহাবাদের অনুকরণে অসহায়দের মাঝে দান-খয়রাত, খাদ্য বিতরণ উত্তম আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম।
তারিখটি নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। আমরা এটির দিকে না যাওয়াটাই সমীচীন মনে করি। কারণ আল্লাহর হাবিব (সা.) দুনিয়া থেকে পর্দা নেওয়ার কিছুদিন আগে অল্প দিনের জন্য যে রোগ মুক্ত হয়েছিলেন সেটা তো সত্য, তাই দিনটিকে উদযাপন করতে দোষের কিছু দেখি না। নফল নামাজ, প্রার্থনা, দান, সদকা করা তো শরিয়তবহির্ভূত কর্ম নয়। হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, রাসূল (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠ গুনাহগুলোকে এমনভাবে মিটিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। আর রাসূল (সা.) এর ওপর সালাম অনেকগুলো গোলাম আজাদ অপেক্ষা উত্তম (তাবকাতে শাফেইয়্যাহ লিসসুবকি ১/৯২)।
হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে আদর্শ বানাতে চায়, সে যেন এমন ব্যক্তিকে আদর্শ বানায় যারা পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। কেননা জীবিতরা ফেতনামুক্ত নয়। আর তারা হলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবারা। কারণ তারা অন্তরের দিক থেকে এ উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। ইলমে সবচেয়ে সুগভীর, চরিত্র ও আচার-ব্যবহারে সবচেয়ে অকৃত্রিম। তারা এমন এক সম্প্রদায়, যাদের আল্লাহ তাঁর নবির সাহচার্যের জন্য মনোনীত করেছিলেন। তোমরা তাদের অধিকার স্বীকার কর। এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ কর এবং যথাসম্ভব তাদের সিরাত আখলাক আঁকড়ে ধর। কারণ তারা ছিলেন সরল ও সঠিক পথের পথিক (মেশকাত)।
মেশকাত শরিফের হাদিসটি অনুকরণে আমরা সম্মানিত সাহবাদের পদাঙ্ক অনুসরণে আখেরি চাহার শোম্বা দিনটি নফল নামাজ, দরুদ, সালাম, গরিবদের মাঝে দান-খয়রাতের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করে আল্লাহ পাকের রহমতের চাদরের ছায়াতলে অবস্থান নেওয়ার চেষ্ট করি।
উল্লেখ্য, এ বছর ২৭ সফর মোতাবেক ১৩ সেপ্টেম্বর পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা পালিত হবে। সম্প্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা শায়লা শারমিন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ খবর জানানো হয়েছে।