Friday, September 20, 2024

‘আমেরিকান ড্রিম‘ জাহাজ পালানো বাঙালিদের

অর্থভুবন ডেস্ক

উন্নত জীবনের আশায় পূর্ব বাংলার কিছু দুঃসাহসী মানুষ প্রায় ২০০ বছর আগে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পৌঁছানোর জন্য এক রোমাঞ্চকর পথ অবলম্বন করেছিলেন। তারা জাহাজের খালাসি বা সারেং হয়ে নাবিকের চাকরি নিয়ে জাহাজে উঠতেন। তারপর জাহাজ থেকে লাফিয়ে সাঁতরে তীরে উঠতেন। তারাই গড়ে তোলেন আমেরিকায় বাঙালি বসতি। 

জাহাজ পালানোর দল

১৭৮৫ সালের শুরু থেকে পূর্ব বাংলার কিছু লোক জাহাজ থেকে পালিয়ে আমেরিকায় বসতি গেড়েছিলেন। আমেরিকান নথিতে তাদের পরিচয় ‘শিপ জাম্পার’ বা জাহাজ পালানো। জাহাজ থেকে লুকিয়ে ইমিগ্রেশনের চোখ এড়িয়ে গোপনে যারা ভিনদেশের মাটিতে আশ্রয় নেয়, তাদেরই বলা হয় শিপ জাম্পার।

প্রথম পদক্ষেপ

রম্যলেখক সৈয়দ মুজতবা আলী ‘নোনাজল’ গল্পে তুলে ধরেছেন একজন বাঙালি জাহাজের খালাসি থেকে কীভাবে আমেরিকায় থিতু হয়েছিলেন। জাহাজ থেকে তীরে পৌঁছানোর ঘটনা উঠে এসেছে এভাবে, ‘আমাকে সাহায্য করতে হলো শুধু একটা পেতলের ডেকচি জোগাড় করে দিয়ে। সন্ধ্যার অন্ধকারে সমীরুদ্দী সাঁতারের জাঙিয়া পরে নামল জাহাজের উল্টো ধার দিয়ে, খোলা সমুদ্রের দিকে। ডেকচির ভেতরে তার জুতো, মোজা আর একখানা তোয়ালে। বুক দিয়ে সেই ডেকচি ঠেলে ঠেলে বেশ খানিকটা চক্কর দিয়ে সে প্রায় আধা মাইল দূরে গিয়ে উঠবে ডাঙায়। পাড়ে উঠে, তোয়ালে দিয়ে গা মুছে, জাঙিয়া ডেকচি জলে ডুবিয়ে দিয়ে শিস দিতে দিতে চলে যাবে শহরের ভেতর। সেখানে আমাদেরই এক সিলেটি ভাইকে সে খবর দিয়ে রেখেছিল হামবুর থেকে। পুলিশের খোঁজাখুঁজি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকবে কয়েক দিন, তারপর দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে চলে যাবে নুউক থেকে বুগুরে, যেখানে সিলেটিরা কাঁচা পয়সা কামায়। পালিয়ে ডাঙায় উঠতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার যে কোনো ভয় ছিল না তা নয়, কিন্তু একবার স্যুটটি পরে রাস্তায় নামতে পারলে পুলিশ দেখলেও ভাববে সে নুউক-বাসিন্দা, সমুদ্রপাড়ে এসেছিল হাওয়া খেতে।’

জাহাজ বন্দরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলবদ্ধভাবে বা এককভাবে জাহাজ থেকে কীভাবে পালাবেন এবং কোন পথে কে কোথায় যাবেন, সেটি আগে থেকে নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না। তবে যতটুকু সম্ভব নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে এবং অন্য কোনো শিপ জাম্পারের পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে খালাসিরা যতটুকু সম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন। জাহাজ বন্দরে ভিড়লে জাহাজের সব কর্মচারীকে ‘ইমিগ্রেশন শোর পাস’ দেওয়া হতো। সেই পাসের কল্যাণে জাহাজের কর্মচারীরা বন্দরে শুধু নির্দিষ্ট একটি এলাকায় আইনগতভাবে থাকার অনুমতি পেতেন। জাহাজ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আবার বন্দর ত্যাগ করা ছিল বাধ্যতামূলক। একজন খালাসি ঠিক এমন মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় থাকতেন। শোর পাস নিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গা ঢাকা দেওয়াই ছিল তখন তার অন্যতম কাজ। সাধারণত নিউ ইয়র্কের এলিস আইল্যান্ড, নিউ জার্সির আটলান্টিক সিটি, এলিজাবেথ, আসবারি পার্ক, লং বিচ এসব নিরাপদ স্থানে জাহাজের খালাসিরা পালানোর সবচেয়ে ভালো আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিতেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে জাহাজের যেকোনো ধরনের একটা খালাসির কাজ নিয়ে আমেরিকা অথবা বিলেতের বন্দরে গোপনে গা ঢাকা দেওয়ার অভিনব কৌশলটি পূর্ব বাংলাসহ পাকিস্তান-ভারত উপমহাদেশের স্বপ্নবাজ কিছু মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। পূর্ব বাংলা থেকে আসা বাঙালিদের কাছে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ‘কলকাতা বা হুগলি বন্দর থেকে কোনো ব্রিটিশ বা ইউরোপিয়ান জাহাজে চড়ে লন্ডন, তারপর লিভারপুল এবং লিভারপুল থেকে নিউ ইয়র্ক অথবা বাল্টিমোর’ যাওয়ার রুটটি।

আমেরিকার জীবন

জাহাজের শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি খালাসিদের কঠোর শারীরিক কাজ করতে হতো। জানা যায়, এই ব্রিটিশ জাহাজগুলোতে সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টার মতো তাদের কাজ করতে হতো। এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে তারা যে পারিশ্রমিক পেতেন, তাতে ভবিষ্যৎ সঞ্চয় তো দূরের কথা, দেশে ফেলে আসা দরিদ্র সংসারেও কিছু পাঠাতে পারতেন না। তবে যেহেতু তাদের সবার মূল লক্ষ্য ছিল আমেরিকা অথবা বিলেত যাওয়া, তাই অবলীলায় এই কঠিন পরিশ্রমকে তারা মেনে নিতেন। তাদের স্বপ্ন ছিল আমেরিকায় পৌঁছে কোনো রকম একটা কাজ জোগাড় করে জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়া।

নাগরিকত্বের কাগজ

শিপ জাম্পারদের স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়াত আইন। নাগরিকত্বের বৈধ কাগজ না থাকলে স্থায়ীভাবে বসবাস করার আইনগত কোনো ভিত্তি থাকত না। নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র বানানোর জন্য তারা স্থানীয় কোনো আমেরিকান (আফ্রিকান, আমেরিকান

অথবা পুয়েরতোরিকান) নারীকে চুক্তিতে বিয়ে করতেন।

আমেরিকান বাঙালিদের সহযোগিতা

শিপ জাম্পার বা নতুন আসা বাঙালিকে সহযোগিতা করতেন বাঙালি বসতির অন্যরা। ভিনদেশের মাটিতে কীভাবে এক বাঙালি আরেক বাঙালির পাশে এসে দাঁড়াবেন, সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন, বৈধ কাগজপত্র করার কৌশলটি শিখিয়ে দেবেন অথবা যেকোনোভাবে হোক কারও বৈধভাবে থাকার কোনো গতি করে দেবেন, সে বিষয়ে তাদের সবার মধ্যেই এক অসাধারণ অলিখিত ঐক্য ছিল। নিউ ইয়র্ক বলুন অথবা বাল্টিমোর অথবা নিউ অরলিন্স বাঙালিরা যাতে চোখ বুজে কারও বাড়িতে উঠতে পারেন, কাজ জোটা না পর্যন্ত দুটো খাবার খেতে পারেন এবং কাজ চালানোর জন্য বাড়ির ঠিকানাটা ব্যবহার করতে পারেন, সে জন্য আগেভাগেই সব ধরনের ব্যবস্থা করে রাখা হতো।

আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে এভাবেই কিছু স্বপ্নচারী পূর্ব বাংলার বাঙালি জাহাজের খালাসি হয়ে কঠিন জীবনযুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন এবং আমেরিকায় তাদের বসত গড়েছিলেন। তাদের রেখে যাওয়া পদচিহ্ন অনুসরণ করে আমরা আমাদের অস্তিত্বের ইতিহাস নির্মাণ করি।

 
 
 
spot_imgspot_img

সাংবাদিকদের গণহারে হত্যা মামলায় আসামি করায় বিএফইউজের উদ্বেগ

সাংবাদিকদের গণহারে হত্যা মামলায় আসামি করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)। পাশাপাশি বন্ধ গণমাধ্যম খুলে দেওয়া, নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন, সাগর-রুনিসহ...

ইউক্রেন সীমান্ত এলাকায় রাশিয়ার মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত

ইউক্রেন সীমান্তবর্তী রাশিয়ার একটি এলাকায় দেশটির মালবাহী একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। অনুমোদিত না এমন ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপের পর ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। বুধবার রেল অপারেটর এ...

ইসরাইলকে মৌলিক পরিবর্তনের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন ইসরাইলের প্রতি পশ্চিমতীরে তাদের কার্যক্রমে মৌলিক পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। পশ্চিমতীরে সম্ভবত একজন মার্কিন নাগরিককে হত্যার কথা ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর স্বীকারের...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here