অর্থভুবন ডেস্ক
শাইখ সিরাজ বাংলাদেশে একটি কেবল নাম না, তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি বলা যায়। তিনি আমার কাছে দারুণ এক রোল মডেল। শাইখ ভাই যে কাজ করেছেন তাতে আমার মতো অনেকের কাছেই তিনি সেই রকম ব্যক্তিত্ব। তার জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানাই, শ্রদ্ধা এবং ভালেবাসা জানাাই। এসবের আগে পাঠককে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, তার কীর্তি সম্পর্কে। এই পৃথিবী তো বটেই, বাংলাদেশেও এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যারা উন্নয়নকে সামনে আনতে চান। কিন্তু মানব উন্নয়নকে কিন্তু সবাই সামনে আনেন না। তিনি কেবল উন্নয়নে কাজ করেছেন তা নয়, মানব মর্যাদা বৃদ্ধিতেও কিন্তু কাজ করেছেন।
তাকে তো সবাই কৃষির একজন বিপ্লবী বলে মনে করেন, কিংবদন্তি বলে মনে করেন। কিন্তু শাইখ ভাই অনন্য আরেকটা কারণে। চার দশক ধরে তিনি যে কাজ করে চলেছেন তা কেবল সাধারণ মানুষের জন্য। কৃষকরা আগে কেবল মাঠেই কাজ করতেন, যে কৃষাণী আগে কেবল ঘরেই কাজ করতেন। কিন্তু তাদের সেই চাষাবাদ, ঘর সামলানোর কাজগুলোকে শাইখ সিরাজ এমনভাবে মিডিয়ার মাধ্যমে, তার কথায়, তার লেখনীতে উপস্থাপন করেছেন যে এই মাঠে ও ঘরে কাজকরা মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে মূল্যায়িত হওয়ার দিশা পেয়েছেন।
শাইখ সিরাজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ থেকে শুরু করে আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের জন্য কেবল কথাই বলেননি, তিনি তাদের জন্য কাজ করেছেন, মাঠে নেমেছেন। আমারও সুযোগ হয়েছে, সৌভাগ্য হয়েছে তার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার। অনেকটা তার কাজের জন্যই চ্যানেল আই আমাদের প্রিয় সংবাদমাধ্যম হয়ে উঠেছে। এখন তো বলা যায় যে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও একটা অংশ হয়ে গেছে চ্যানেল আই। কখনো কোনো সময় যদি মনে হয় আজ তো চ্যানেল আই দেখা হয়নি তখন গাড়িতে বসে একটু মোবাইলে চ্যানেল আই দেখে নিলাম। এটি কিন্তু বাংলাদেশে বহু মানুষ করেন। শাইখ ভাই এখানে অন্য একটি কারণে অনন্য। একদম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ যারা, যাদের আমরা চিনি না তারা যেমন তাকে চিনেছেন, তিনি নিজে যেমন তাদের ভেতর থেকে চিনেছেন, তেমনি তাদেরও আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ফলে এই অনন্য শাইখ সিরাজের কাজটি কী, সেটি যদি আমরা না বুঝি তাহলে আমরা তাকে মূল্যায়ন করতে পারব না।
আমরা অনেকে যারা মাঠে-ময়দানে কাজ করি, এই যেমন আমি শিক্ষা নিয়ে কাজ করি আমরা জানি যে প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতার মূল্য কত। শাইখ সিরাজ তার কাজের মাধ্যমে ঠিক কৃষকের মনের কথা, অভিজ্ঞতার কথা, প্রজ্ঞার কথাগুলোকে সাংঘাতিক যত্ন করে সামনে তুলে এনেছেন।
তিনি কৃষি বিপ্লব করে চলেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। ছাদ কৃষির কথাই ধরুন, আমরা তো কেউ চিন্তাই করতে পারিনি যে, এটা নিয়ে কাজ করা যায়। কে ভাবতে পেরেছিল তার আগে, যে এটাও একটা জনপ্রিয় বিষয় হিসেবে উঠে আসবে জনসম্মুখে। কত মানুষই তো ছাদ কৃষি করে বেড়ান। গৃহকর্তা করছেন, গৃহকর্ত্রী করে চলেছেন। শাইখ ভাই যে কাজটি করেছেন, তা হলো তিনি অসংখ্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। গ্রামে-গঞ্জে সবার মধ্যে শাইখ সিরাজ যেমন একটা নাম, তেমনি নগরবাসীও তাকে চিনেছেন আলাদাভাবে। তার একটা ফ্যানক্লাব তৈরি হয়ে গেছে।
সারা জীবন মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে চষে বেড়িয়েছি উন্নয়নকর্মী হিসেবে। কিন্তু আমি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হলাম, শাইখ ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে ধানক্ষেতে ধানক্ষেতে নেমে গেছি, ধান কাটতে হয়েছে। এটি আমার একটা মজার অভিজ্ঞতা ছিল। তখন অনুধাবন হলো মনের মধ্যে, যে কত কষ্ট করেন আমাদের কৃষকরা। ধান কাটতে আমার কষ্ট লেগেছে, কিন্তু কৃষকরা যে দিবারাত্রি পরিশ্রম করেন সেটি একেবারে অন্তরে অনুধাবন করেছি ওই সময়ে। সেজন্য শাইখ ভাইকে স্যালুট জানাই। তিনি কেবল মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন তা নয়, তাদের ভেতরে মানবিকতা বোধ, চেতনা বোধ উজ্জীবিত করছেন।
আরও মজার ঘটনা আমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে থাকার সুবাদে শাইখ ভাইয়ের সঙ্গে একটা যোগাযোগ ছিল। উনি আমাদের উৎসাহিত করলেন নৌকা বাইচ দেখতে যাওয়ার জন্য। সেই নৌকা বাইচ দেখতে গিয়ে দেখলাম বাংলার শ্বাশত সংস্কৃতি। শাইখ ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন নৌকাবাইচ দেখতে, উদ্বোধন করলাম, নৌকাতে উঠিয়ে ছাড়লেন। এই হচ্ছে শাইখ ভাই।
তার আরেকটি জিনিস যেটি আমার খুব খুব ভালো লাগে সেটি হলো উনি কিন্তু উন্নয়নের সব শাখায় দৃষ্টি দেন। চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান, আবার নিজে সপ্তাহে একটা প্রামাণ্য অনুষ্ঠান তৈরি করছেন। আমি জানি রেকর্ডিংয়ের জন্য তিনি ফজরের আজানের আগে বেড়িয়ে যান। আমি যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত গণসাক্ষরতা অভিযান, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব করে তিনি চ্যানেল আইয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষা সংবাদ প্রচার করে গেছেন। ধারণাটা যদিও আমাদের কাছ থেকে গিয়েছিল কিন্তু সেটিকে তিনি এমনভাবে পুষ্পে পল্লবিত করেছেন যে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষা সংবাদ নীতিনির্ধারকদের কাছে অন্যভাবে আলোড়ন তুলেছিল।
আমার জানা মতে সে সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দুজন কর্মকর্তা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন প্রতিদিন শিক্ষা সংবাদ মনিটরিং করার। তাকে শ্রদ্ধা জানাই। শাইখ সিরাজ বহু মানুষের কাছে পূজনীয় মানুষ, কিংবদন্তিতুল্য মানুষ, ফলো করার মতো মানুষ। তার পারিবারিক মূল্যবোধ নিয়ে খানিকটা না লিখলে বড় অন্যায় হবে। পুরো পরিবারকে একসঙ্গে ধরে রাখার কাজটি তিনি করেছেন নেপথ্যে থেকে, অনেকে হয়তো জানেন না। তারা সব ভাই-বোন খিলগাঁওয়ে পৈতৃক বাড়িতে একসঙ্গে বাস করছেন। এক সঙ্গে থাকার এই মানবিক মূল্যবোধ কোনো কোনো মানুষের ব্যক্তিত্বের আড়ালে হারিয়ে যায়।
বর্তমান বাংলাদেশে আমরা যেভাবে দেখতে পাচ্ছি মূল্যবোধের অবক্ষয়, সেখানে শাইখ ভাই তার বাড়িতে এটা সযতনে লালন করে চলেছেন। এটি আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। তার ৭০তম জন্মদিনে আমার চাওয়া, আমাদের তরুণ প্রজন্ম, শাইখ সিরাজের ৪ দশকের উন্নয়ন সাংবাদিকতার মূলমন্ত্র অন্তরে ধারণ করবে, চর্চা করবে। তাকে অনুসরণ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে অগ্রণী ভূমিকায় থাকবে তরুণরা।
লেখক: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা