অর্থভুবন ডেস্ক
প্রথম কথা হলো কে কত টাকা ঘুষ দেয় তা নিয়ে কেউ গবেষণা করেনি। তাই সংখ্যাটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কিন্তু নির্ণয় করা না হলেও চাকরির জন্য হরদম ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। যারা চাকরি পাচ্ছেন তারা সবাই ঘুষ দেন বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু যে অংশটুকু ঘুষের বিনিময়ে চাকরি পাচ্ছে সেটাও কম বড় নয়। আমাদের চারপাশে, খবরের কাগজে যে অভিযোগটুকু বের হয় তা খুবই খন্ডিত। এই খন্ডিত অংশের ওপর ভর করেও বলা যায়, চাকরির ঘুষের বাজারটা অনেক বড়। এটা যদি ২৫ শতাংশও হয় তাহলেও ঘুষের লেনদেনটা ব্যাপক। সামাজিক এ সমস্যা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
ঘুষ দিয়ে চাকরি বিষয়টি এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে যে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া এ থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব না। সরকারি দল, বিরোধী দল বা প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে এর বিপক্ষে সোচ্চার হতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়া এ থেকে বের হওয়া যাবে না।
সবাই বলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। আসলে জিরো টলারেন্স অবস্থান নেওয়া সহজ কথা না। এটা স্লোগান হতে পারে কিন্তু কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে কঠোর অবস্থান নেওয়া সহজ কথা না।
রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে সরকারকেও ভূমিকা নিতে হবে। চাকরির পরিমাণটা যদি বাড়ানো যায় তাহলে ঘুষটা কমতে পারে। বলা হচ্ছে বছরে ৫০ হাজার লোকের সরকারি চাকরি হচ্ছে। এই সংখ্যাটা যদি আরও বাড়ানো যায় তাহলে ঘুষ কমতে পারে। কারণ নির্দিষ্ট সংখ্যক চাকরিপ্রার্থী চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করেন। কিন্তু সরকারের পক্ষে রাতারাতি তা করাও সম্ভব না।
অনেক দেশ এ সামাজিক ব্যাধি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। এর জন্য নানা কর্মসূচি নিচ্ছে। কমিশন গঠন করছে। আমাদের এখানেও পাবলিক সার্ভিস কমিশন রয়েছে। তারা খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারে না। তবে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আওতায় যেটুকু চাকরি হয় তা নিয়ে দৃশ্যত কোনো অভিযোগ নেই। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আওতার বাইরের নিয়োগ নিয়েই সমস্যা। কমিশনের আওতা বাড়িয়ে আরও কিছু চাকরি তাদের আওতায় নিয়ে গেলে এখানে একটা সমাধান বের হতে পারে। কিন্তু কমিশন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে আর যাওয়ার জায়গা থাকবে না।
আত্মকর্মসংস্থানে সাপোর্ট দিতে হবে। এক্ষেত্রে সমবায়ের কথা চিন্তা করা যায়। সমবায়কেন্দ্রিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে বেকারত্ব কমবে। মাছ চাষ বা খামার করে কর্মসংস্থান করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ভূমি ব্যবস্থাপনা সংস্কারের বিষয়টি সামনে আসবে। খাস জমি যেগুলো আছে সেগুলোতে সাধারণ মানুষের ন্যায্য হিস্যা। সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। যেভাবেই হোক এ জায়গাটায় কাজ করার অনেক কিছু আছে। এখানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়েও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কমিশন কাজে দিতে পারে।
ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার মধ্যেও একটা সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। গরিব বাবার সন্তান ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে পারছেন না। তারা জানেন ঘুষ না দিলে চাকরি হবে না। আর কোনোভাবে তারা টাকাটা ব্যবস্থা করতে পারলে পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এখানে যার টাকা আছে সেই ঘুষ দিয়ে চাকরি নিচ্ছে। ধনী পরিবার আরও ধনী হচ্ছে।
ঘুষের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অযোগ্য এবং অনৈতিক লোকজনদের পক্ষে সরকারি চাকরি পাওয়া সম্ভব হয়। চাকরি পাওয়ার পর মানুষের সেবার বদলে কীভাবে নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো যায় তা অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও তারা কার্পণ্য করেন না। তাদের হাতে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব নিরাপদ না।
শুধু চাকরি পেতেই না, পদোন্নতি, বদলি এসব ক্ষেত্রেও ঘুষ লেনদেন হয়। কাজেই চাকরি সংক্রান্ত ঘুষের আকার বের করতে হলে অনেক গবেষণা দরকার। এখানে ঘুষ ছাড়াও অনেক খরচ হয়। আবেদনকারীকে আবেদন করতে খরচ হয়। চাকরির জন্য আবেদন ফিস দিতে হয়। কাগজপত্র ফটোকপি করার খরচ আছে। কিছু সনদ জোগাড় করার খরচ রয়েছে। ছবি তোলা, পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাস্থলে যাওয়া, অবস্থান, খাওয়া এবং ফেরত আসার খরচ রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক খরচ রয়েছে। নিয়োগ কমিটির সম্মানী ও আপ্যায়ন, বিজ্ঞাপন প্রকাশ, আবেদন যাচাই-বাছাই, যোগ্য তালিকা প্রকাশে বিজ্ঞাপন খরচ। এর বাইরেও রয়েছে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন খরচ, প্রশ্ন মডারেশন খরচ, প্রশ্ন ছাপানোর খরচ, প্রশ্ন পরিবহন খরচ। পরীক্ষার খাতা তৈরির খরচ, হাজিরা শিট তৈরির খরচ, যাতায়াত খরচ, পরীক্ষা কেন্দ্র খরচের মধ্যে কাগজ, কলম, সুতা, স্টেপ্লার, পুলিশ বা আনসারের খরচ। এরপরে রয়েছে উত্তরপত্র মূল্যায়ন খরচ। এরপর প্রয়োজন হলে ব্যবহারিক পরীক্ষার খরচ রয়েছে। এসবের সঙ্গে যোগ হবে নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে সম্মানী খরচ। ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হলে তার সম্মানী।
সবকিছু মিলে চাকরির পেছনে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের খরচও কম নয়। সেসব নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।
লেখক : অর্থনীতিবিদ