সৌরভ মাহমুদ
কথা ছিল সুইডেন থেকে নরওয়ে যাব। কিন্তু অসলোতে পৌঁছানোর দিন থেকেই ভারী বৃষ্টি শুরু হলো। এমনই বৃষ্টি যে পরদিনই রেলপথ তলিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে স্টকহোমের পথ ধরলাম। মেঘ-বৃষ্টির অসলো ছেড়ে স্টকহোমে পেলাম উজ্জ্বল ও ঝকঝকে নীল আকাশ। বাল্টিক সাগরের পড়শি এই শহরের চারদিকেই নীল জলরাশি।
স্টকহোম থেকে জাহাজে চেপে ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়া যাওয়া যায় জানতাম। পর্যটক (তানভীর) অপু ভাই ফিনল্যান্ডে আছেন, তাঁর সঙ্গে আলাপ করে সেই পথেই পা বাড়ালাম। পরদিন সকালেই ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি যাওয়ার জাহাজের টিকিট করে ফেললাম। সিলজা লাইনের ১২ তলা জাহাজটির নাম সিলজা সেরেনেড। দশম তলায় সমুদ্রমুখী একটি কেবিন পেলাম ২০৭ ইউরোতে (প্রায় ২৫ হাজার টাকা)।
স্টকহোম থেকে হেলসিংকি প্রায় ১৯ ঘণ্টার সমুদ্রপথ। বিকেল চারটায় জাহাজ ছাড়বে। জার্মানি থেকে যে ফোল্ডিং বাইসাইকেলটা নিয়ে পথে নেমেছি, সেটাই আমার ভ্রমণসঙ্গী। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে এ পর্যন্ত আসতে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু স্টকহোম থেকে ভ্যারটান জাহাজ ঘাটে পৌঁছাতে মনে হলো চট্টগ্রাম শহরের উঁচু-ঢালু পথে সাইকেল চালাচ্ছি। একটু কষ্ট হলো, তবু জাহাজ ছাড়ার প্রায় দেড় ঘণ্টা আগেই এসে পৌঁছালাম। মূল ফটকে ডিজিটাল মেশিন। টিকিটের বারকোড ধরতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকতে সাইকেল ভাঁজ করে নিতে হলো। হেঁটে জাহাজের পাঁচতলায় উঠলাম। একজন অফিসার বললেন, লিফট ধরে দশম তলায় যেতে। জাহাজের টিকিট এটিএম কার্ডের মতো। পাঞ্চ করতে হয় রুমসহ অন্যান্য ফটকে। ইউরোপের যত শহরের হোটেলে থেকেছি, সবখানেই এই ব্যবস্থা। তাই কার্ড রেখে রুম থেকে বের হলে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়।
সন্ধ্যার বাল্টিক
রুমে জিনিসপত্র রেখে জাহাজের ছাদে চলে গেলাম। জাহাজে ওঠার সময় আর ছাদে এসে বুঝলাম, ক্রুজে অনেকেরই এটা প্রথম ভ্রমণ। সবার চোখেমুখে রোমাঞ্চ। অনেকই সেলফি তুলছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর জাহাজ ছাড়ল।
টেবিলে বসে প্রকৃতি দেখতে লাগলাম। হালকা বাতাস বইছে। উইন্ড জ্যাকেট পড়ে নিতে হলো। জাহাজটি যতই দূরে যাচ্ছে, বাল্টিকের বুকে জেগে থাকা সৌন্দর্য ফুটে উঠছে। আকাশে সাগর-চিলের ডানা ভাসছে। হিমবাহে তৈরি দ্বীপের মাঝে জেগে থাকা লাল-খয়েরি-হলুদ কাঠের বাড়িগুলো অপূর্ব লাগছে। বাতাসে গাঙচিলের ডানার ঘ্রাণ পাচ্ছি। একটা সাগর-চিল কোথা থেকে উড়ে এসে ছাদের ওপর বসল। কিছুক্ষণ পর আবার সে উড়ে চলে গেল। চরাচরজুড়ে সন্ধ্যা নামল। সন্ধ্যার আলোর রূপ দেখতে দেখতে জাহাজের ছাদেই রাত আটটা বেজে গেল।
জাহাজের রাত
রাতের খাবারের সময় হয়েছে। গোসল সেরে খেতে গেলাম। সপ্তম তলায় শপিং মল, স্মরণিকার দোকান, কফি হাউস, বার আর নানান খাবারের রেস্তোরাঁ। রাতে কী খাব ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল একটি বুফে রেস্তোরাঁ। ভেতরে গিয়ে দেখি গমগম করছে মানুষ। ওয়েটার একজন মাঝবয়সী নারী। জানালেন, বুফে মেনু আর দরদাম। টাকা শোধ করার পর টেবিল নম্বর জানিয়ে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন।
৪৮ ইউরোতে অনেক পদের খাবার। সেই সঙ্গে নানা রকম কোমল পানীয় আর জুস। এত সব খাবারের মধ্যে কোনটা খাব, বাছাই করাই মুশকিল। আমি নরডিক স্মোকড স্যামন ফিশ, গ্রিলড চিকেন, পমেস, সবজি, গার্লিক সস নিলাম। সেই সঙ্গে পানীয় ও কমলার জুস।
পেট পূজা শেষে জাহাজের ভেতরটা ঘুরে দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই ক্যাসিনো। হরেক আলোয় জমজমাট ক্যাসিনো। অপর প্রান্তে বাচ্চাদের খেলার জায়গা। নানা ধরনের খেলার সরঞ্জাম আর খেলনায় সাজানো। আছে মিউজিক ইভেন্ট। দুজন তরুণ গায়িকা গান করছে। পর্যটকেরা সেটা দারুণ উপভোগ করছে। কয়েকটি শপিং মল ঘুরে দেখলাম পণ্যের দাম খুব একটা বেশি নয়। সি পাব ও বারগুলো জমজমাট। পানীয় নিয়ে খোশগল্প করছে নানান বয়সী মানুষ।
বাল্টিকে সূর্যোদয়
রাত প্রায় ১০টা। সন্ধ্যার আলো তখন সাগরের বুক থেকে নিভে গেছে, জেগেছে চাঁদ আর দূর নক্ষত্ররা। জাহাজ ততক্ষণে প্রধান বাল্টিকের কাছাকাছি। ১২ তলায় চলে গেলাম। খুব বাতাস। রাতের নিস্তব্ধতা বাড়ছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেটা ডিসকো ক্লাবের বেশ কাছে। রাতের বাল্টিক সাগরের ঢেউয়ের গান শুনছি। সামনে এক নারী এসে দাঁড়ালেন। বয়স ত্রিশের কোঠায়। আমাকে হ্যালো বলে মিষ্টি হাসলেন। ফিনিশ ভাষায় কী যেন বললেন। কিছুই বঝলাম না। বললাম, আমি ফিনিশ বুঝি না, তবে ইংরেজি ও জার্মান জানি। সে বলল তাহলে ইংরেজিতে কথা হোক। নানা বিষয়ে গল্প হলো। বিশেষ করে ভ্রমণ নিয়ে। বলল, তারা এ রকম জার্নিতে সারা রাত জেগে থাকে, ডিসকোতে নাচে ও আনন্দ করে। সে চলে যাওয়ার সময় বলল, অন্য কোথাও আবার দেখা হবে, অন্য কোনো দিন!
তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। সাগরের নীলাভ জলেও অন্ধকারে জমে গেছে। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম তেমন হলো না। ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে পড়লাম বাল্টিক সাগরের বুকে সূর্যোদয় দেখব বলে। সেই কবে কুয়াকাটা বিচে গিয়ে সূর্যোদয় দেখেছি!
ছাদে গিয়ে দেখি জোর বাতাস। নিচে নেমে ছয়তলার লম্বা ব্যালকনিতে চলে এলাম। ছয়টার দিকে বাল্টিক সাগরে ভোর হলো। এই ভোর পাখির পালকের মতো নরম। এমন নরম ও সুন্দর ভোরের সাক্ষী হলাম অনেক দিন পর। ততক্ষণে জাহাজ ফিনল্যান্ডে সমুদ্রসীমার মধ্যে হ্যানকো উপকূলে ঢুকে পড়েছে। সমুদ্র চিল ও পানকৌড়ি ওড়াউড়ি শুরু করেছে। সাতটা পর্যন্ত মিষ্টি রোদের আলো গায়ে মেখে সেখানেই বসে থাকলাম।
অবশেষে হেলসিংকি
সকাল পৌনে ১০টায় হেলসিংকি উপকূলের কয়েকটি দ্বীপ চোখে পড়ল। কয়েকবার ভেবেছি, আমি কি নিউজিল্যান্ড চলে এলাম। ধীরে ধীরে খুব কাছে চলে এল ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত দ্বীপমালা সুওমেনলিন ও সেখানকার দুর্গ। একটু পর হেলসিংকি ক্যাথেড্রাল। জাহাজের ছাদে গিয়ে দ্বীপগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। সুওমেনলিনার সুরক্ষিত দ্বীপগুলো হেলসিংকির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত।
হেলসিংকি বন্দরে জাহাজ নোঙর করল। এর মধ্যেই অপু ভাইয়ের কল। তিনি আমাকে অতিথি হিসেবে স্বাগত জানালেন। ছেলেবেলায় জমানো ফিনল্যান্ডের ডাকটিকিটের ছবিটা মনের চোখে ভেসে এল। সেই ডাকটিকিট প্রথম দেশটি সম্পর্কে জানার ও ভ্রমণ করার প্রেরণা জুগিয়েছিল। এখন আমি সেই সুন্দর ও শান্ত দেশে।