Friday, November 8, 2024

মায়ের স্কুল মেয়ের জন্য

অর্থভুবন প্রতিবেদক

কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্টাফ নার্স তিনি। কোনো দিন রোগীকে অবহেলা করেননি। অথচ নিজের প্রতিবন্ধী কন্যাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল স্কুল থেকে। সেই বেদনাবোধ থেকেই রিকতা আখতার বানু ব্রহ্মপুত্র নদের পারে গড়ে তুলেছেন বিশেষ ধরনের এক শিক্ষায়তন।

 

প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের ভরসার স্থান হয়ে উঠেছে রিকতা আখতার বানুর (লুত্ফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল। এরই মধ্যে এটি এমপিওভুক্ত হয়েছে। ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারী বেতন-ভাতা পান।

স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে দুঃখিনী মা রিকতা আখতার বানুর ক্ষোভ আর বেদনার করুণ গল্প।

 
রিকতার মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মনি বাকপ্রতিবন্ধী। ২০০৮ সালে ইউপি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তির চেষ্টা করেন রিকতা। অনেক অনুরোধের পর তানভীন দৃষ্টি মনিকে ভর্তি করানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিন পর তাকে আর পড়াতে চাননি শিক্ষকরা।
 
রিকতা বানু বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে জানলাম, প্রতিটি স্কুলে প্রতিবন্ধীদের জন্য পাঁচটি আসন রয়েছে। অনেক পীড়াপীড়ি করে মেয়েকে ভর্তি করাতে পারলেও কয়েক দিন পরে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় স্কুল থেকে। ভাবলাম, আমার মতো অনেক অভিভাবক তাঁর সন্তানকে নিয়ে এমন বিপদে নিশ্চয়ই পড়েছেন। তাই নিজেই স্কুল করার উদ্যোগ নিলাম।’ ২০১০ সালে স্কুল তৈরির কাজ শুরু করেন রিকতা।
 
এগিয়ে আসেন তাঁর স্বামী। স্কুলের নামে দান করেন ২৬ শতক জমি। এরপর নিজেদের অর্থায়নেই দোচালা একটি টিনের ঘর তোলেন। চারজন শিক্ষককে নিয়ে যাত্রা শুরু করে রিকতা বানুর স্বপ্নের স্কুল।

 

 

ব্রহ্মপুত্রপারের আলো

রিকতা বানুর স্কুল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের দূরত্ব ৪০০ মিটারেরও কম। রমনা ঘাট থেকে কুড়িগ্রাম অভিমুখী সড়কের পাশেই রমনা গ্রামে আধাপাকা ভবনে চলছে স্কুলের কার্যক্রম। থানাহাট, ডাওয়াইটারি, জোড়গাছ, গুরাতিপাড়া, সরকারপাড়াসহ ব্রহ্মপুত্রপারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা আসে এখানে। কেউ কেউ আসে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূর থেকে। তাদের আনা-নেওয়ার জন্য রয়েছে তিনটি ভ্যান। প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় স্কুলটিতে।

শাহীন শাহ, রুজিনা, মহসিন ও লতিফা আক্তার নামের চারজন শিক্ষক স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে একসময় প্রতিবন্ধীদের প্রাথমিক পাঠ দিতেন। এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কাজ করছেন। নানা কৌশলে শেখাচ্ছেন পড়াশোনা। পাশাপাশি ফেসিয়াল মাসাজ, স্পিচ থেরাপিসহ নানা থেরাপির মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছেন এই শিশুদের। প্রধান শিক্ষক শাহীন শাহ জানান, খেলার সামগ্রী এবং আরো কিছু সরঞ্জাম দরকার তাঁদের। প্রয়োজন নিয়মিত প্রশিক্ষণের। এখানে বিশেষ ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়। তবে একীভূত শিক্ষার ব্যবস্থা না করলে সমাজের মূলধারায় জায়গা করে নিতে এই শিশুদের সমস্যা হবে। তাই কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি জরুরি।

 

মায়াময় এক ভুবন

৬৩ জন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয় স্কুলটির। তখন শিক্ষার্থীদের দুপুরের নাশতার টাকা এবং অন্যান্য খরচ জোগাতে রিকতা বানু সংসারের বাজেট কাটছাঁট করেছিলেন। স্কুলটি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর শিক্ষক-কর্মচারীরা সেই দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁরা চাঁদা দিয়ে শিক্ষার্থীদের দুপুরের নাশতা দেন। তবে এখনো সপ্তাহের এক দিন আর বিশেষ দিনে নাশতা কিংবা দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেন রিকতা বানু। শিশুদের তিনি মায়ের আদরে বড় করছেন। রিকতা বানুর কথা, ‘এরা সবাই আমার সন্তান, এদের জন্য সব সময় মন কাঁদে, মায়া লাগে। তবে আমার স্বামী পাশে না থাকলে এত দূর আসা সম্ভব হতো না।’

 

ডানা মেলছে স্বপ্ন

রিকতা বানুর মেয়ে দৃষ্টি মনি এখন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কথা বলতে না পারলেও সব সময় মিষ্টি হাসি লেগে থাকে তার ঠোঁটে। এখন নিজের কাজ, বাড়ির কাজ আর পড়াশোনার কিছু কাজ নিজেই করতে পারে। অন্য শিশুশিক্ষার্থীদেরও অনেকেই ধীরে ধীরে জড়তামুক্ত হচ্ছে, শিখছে কথা বলা। পঞ্চম শ্রেণির ক্লাসের আল আমিন বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। আগে কিছুই বলতে পারত না সে। স্পিচ থেরাপিসহ শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় এখন ছড়া পাঠ, কোরআন তিলাওয়াতসহ লেখাপড়ায় তার আগ্রহ শিক্ষকদের আশা জাগাচ্ছে। মোস্তফার মা ও বাবা দুজনই প্রতিবন্ধী। তার পরও থেমে নেই তার শিখন কার্যক্রম। আরেক শিক্ষার্থী নাজমা আখতার লাকি বলে, ‘আগে পাঁচ টাকা চিনি নাই, এখন চিনি।’ শিক্ষার্থী সাদিয়া আখতারের মা রেশমা বেগম বলেন, ‘চিলমারীতে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো স্কুল নেই। রিকতা আপার স্কুলটিই আমাদের ভরসা।’

 

আরো স্বপ্ন

রিকতা বানু স্বপ্ন দেখেন তাঁর স্কুলটি হবে আবাসিক। দূর-দূরান্ত থেকে শিশুরা এখানে আসবে। হাতে-কলমে শিক্ষা নিয়ে সমাজের মূলস্রোতে মিশবে অবহেলিত সেই শিশুরা। বর্তমানে বাতজ্বরে কাবু হয়ে বেশির ভাগ সময় বিছানায় কাতরান রিকতা বানু। চাকরি আর সংসারের বোঝা টানতে চরম বেগ পাচ্ছেন। তার পরও অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে দেখেন আলোর হাতছানি। মৃত্যুর আগে তিনি স্বপ্নের স্কুলটির আরো প্রসার চান, হাসি ফোটাতে চান আরো অনেক মলিন মুখে।

spot_imgspot_img

মায়ের ঘুমপাড়ানি সুর শান্তিধারা

আমাদের জোনাকজ্বলা গ্রাম বিদ্যুৎ তখনও দেখেনি। সন্ধ্যার কাছে বিকেল নতজানু হতেই সবুজ পাহাড়েরা মিশকালো হয়ে যায়। ফলে- আমরা চালের ফুটো দিয়ে চাঁদ দেখি, আর...

মাহবুবা ফারজানা নতুন তথ্য সচিব

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বেগম মাহবুবা ফারজানা। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ছিলেন। তাকে সচিব পদে পদোন্নতি...

এ এস এ ফাউন্ডেশনের এডুকেশন ফেয়ার প্রতিমাসেই

উচ্চ শিক্ষার্জন, জ্ঞানগর্বের অংশ। বিশ্বব্যাপী ইহার মুক্ত পরিবেশ বিবেচিত হওয়া উচিত। বিশ্বের নাম্বার ওয়ান রাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে ভর্তি মেলার আয়োজন...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here