অর্থভুবন ডেস্ক
মিরসরাই উপজেলার পূর্বদিকে সারি সারি পাহাড় আর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মিলিত হয়েছে ফেনী মুহুরী নদী। ফেনী মুহুরী নদীর ভাঙনে কয়েক দশকে নদীগর্ভে ঘরবাড়ি, কৃষিজমিসহ সর্বস্ব হারিয়ে বাস্তুহীন হয়েছে শত শত পরিবার।
আশির দশকে নদীর ভয়াবহ ভাঙন রোধ করার জন্য বাঁধ দেওয়া হলে হাজার হাজার একর চর জেগে ওঠে। নদীতে চর জেগে ওঠার পর সেই জমি কৃষকের স্থলে এক নম্বর খতিয়ানভুক্ত হয়ে সরকারের মালিকানায় চলে যায়। চরে সাগরের জোয়ারে লোনা পানি ওঠার কারণে ফসল না হওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে গবাদিপশুর চারণভূমিতে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে সেই চরে গড়ে উঠে কৃষকের শত শত গবাদিপশুর খামার। এসব খামারে গরু, মহিষ, ভেড়া
ও ছাগল পালন হতো। নব্বইয়ের দশকে এসব জমি মুক্তিযোদ্ধা ও ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ শুরু হয়। হাত বদল হয়ে এসব জমিতে গড়ে উঠে প্রভাবশালীদের ২ হাজারের অধিক মৎস্য খামার। ধীরে ধীরে পশু চারণভূমি মৎস্যচাষির জালে সংকুচিত হতে থাকে।
২০১০ সালে চরাঞ্চলের পশু চারণভূমিতে শুরু হয় এশিয়ার বৃহৎ শিল্প স্থাপনের কর্মযজ্ঞ। ৩৩ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য। শিল্প-কলকারখানা নির্মাণের দাপটে সংকুচিত হয়ে কমতে থাকে গবাদিপশুর চারণভূমি। কর্মযজ্ঞ চলে রাত-দিন। চরের লোনা পানিতে গড়ে ওঠে ইট-পাথরের দেয়াল। সড়কবাতি আর শ্রমিকের কোলাহলে সম্ভাবনাময় গবাদিপশুশিল্প বন্দি হয়ে যায় ইট-পাথরের দেয়ালে।
অনেকেই ইছাখালীর চরে গরু-মহিষ, ভেড়া ও ছাগল পালন করে সফল হয়েছেন। উন্মুক্ত চরে গবাদিপশুর খামার খুলে আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি অনেক বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে অবদান রাখেন দেশের অর্থনীতিতে।
মিরসরাই উপজেলার ওচমানপুর, মঘাদিয়া, ইছাখালী ও শাহেরখালী ইউনিয়নের কৃষকরা চরে গরু-মহিষ ও ভেড়া পালন করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বর্তমানে এখানকার শিল্প-কলকারখানা ও মৎস্য প্রকল্পের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে গবাদিপশুর খামার, বদলে দিচ্ছে মিরসরাইয়ের চরাঞ্চলের অর্থনীতি।
ইছাখালী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ফজলুল হক (৬৫) জানান, তার বাবা হাবিবুল্লাহ হাজি ৪০ বছর আগে দুই-চারটা গরু-মহিষ দিয়ে শুরু করেন খামার। পরবর্তীতে খামারে কয়েকশ গরু, মহিষ, ভেড়া ছিল। তিল তিল করে গড়ে তোলা পশু খামার চারণভূমির অভাবে এখন বিলীন হওয়ার পথে। সব বিক্রি করে দিয়ে এখন ৩০টি মহিষ, ২০টি গরু আছে। তিনি দাবি করেন, এখন পশুশিল্পটি রক্ষায় সরকারের সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। সুপার ডাইক সড়কের বাইরে নদীর মোহনায় নতুন যে চর জেগে উঠেছে সেখানে পশুর চারণভূমি গড়ে তুললে এ শিল্প কিছুটা রক্ষা পাবে।
মিরসরাইয়ের চরাঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নের ব্যাপারে চেয়ারম্যান নুরুল মোস্তফা বলেন, ‘উপকূলীয় চরাঞ্চলের মানুষ বেশির ভাগ কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। গরু, মহিষ, ভেড়া ও ছাগল পালন এবং সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ইট-পাথরের দেয়ালে বন্দি কৃষকরা। চরাঞ্চলের জমি অধিগ্রহণের পর কৃষকরা বেকার হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক আঞ্চলের বাইরে নতুন জেগে ওঠা চরে গবাদিপশু পালনের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলাটা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
মিরসরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাকিরুল ফরিদ জানান, মিরসরাইয়ের চরাঞ্চলে এক সময় প্রচুর মহিষ ছিল। গবাদিপশুর জন্য দরকার চারণভূমি। মিরসরাইয়ের চরাঞ্চল গবাদিপশু লালন-পালনে বিপুল সম্ভাবনাময় এলাকা। এখানে প্রাকৃতিকভাবে গবাদিপশুর প্রয়োজনীয় খাদ্য তৈরি হয়। গবাদিপশুর মালিকরা সরকারের সঠিক পরিকল্পনা পেলে বদলে যাবে শত শত জীবন। অভাবী মানুষের মুখে ফুটবে মুক্তির হাসি।