অর্থভুবন প্রতিবেদক
প্রায় আট বছর আগের কথা। কুড়িগ্রামে ‘গ্রিন ইকো’ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন যাত্রা শুরু করে। সবুজ অর্থনীতি তৈরি তাদের অন্যতম লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে তারা হাতে তৈরি এমন এক পরিবেশবান্ধব কলম তৈরি করেন, যা ব্যবহার শেষে মাটিতে ফেলে দিলে কলমের উপাদান মিশে যাবে মাটির সঙ্গে। সেখান থেকে গজাবে একটি গাছের চারা। গ্রিন ইকোর প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জয় চৌধুরীর কাছ থেকে শুনে লিখেছেন আমীন আল-রাজীব
সঞ্জয় চৌধুরীর জন্ম কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার কালীগঞ্জ ইউনিয়নের ভবানন্দের কুটি গ্রামে। শৈশবে বন্ধুরা যখন প্রজাপতি, ফড়িং ধরত, খেলার ছলে মেরেই ফেলত তখন সঞ্জয়ের দিন কাটত বৃক্ষ, ফড়িং, প্রজাপতি, পাখির অপরূপ শোভা দেখে, মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে। তিনি তখনই বুঝতে পারেন এদের মারতে নেই। এদের ভালোবাসতে হবে। ২০১৪ সালে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির পর থেকে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনে যুক্ত হন সঞ্জয়। প্রথম বর্ষে পড়ার সময় কাজ শুরু করেন নদী সুরক্ষায় কাজ করা সংগঠন রিভারাইন পিপলের সঙ্গে। সেই সঙ্গে ক্যাম্পাস সবুজায়নের কাজে যুক্ত হন। এর পরের বছরই তাঁর প্রতিষ্ঠিত পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন ইকো যাত্রা শুরু করে। সঞ্জয় চৌধুরী গ্রিন ইকোর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করছি, আমার পড়ালেখার জ্ঞানকে কীভাবে সমাজ ও দেশের কাজে লাগাতে পারি– সেই চিন্তা থেকে একটি সংগঠন গড়ার তাগিদ অনুভব করি। ২০১৫ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে যাত্রা শুরু করে ‘গ্রিন ইকো’ নামের এ সংগঠন।’’ কোনো পরিবেশবাদী সংগঠনকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে নিয়মিত কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য আর্থিক সক্ষমতা জরুরি। যে কারণে ২০২৩ সালে গ্রিন ইকোর সহযোগী সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করে ‘গ্রিন প্রডাকশন’। গ্রিন ইকোনমি বা সবুজ অর্থনীতি তৈরিই যার লক্ষ্য। তাদের মতে, পরিবেশবান্ধব অর্থনীতিই পারে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। এ ধারণা থেকেই প্রতিষ্ঠানটি কাগজের কলম উৎপাদন শুরু করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘গ্রিন পেন’।
সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, ‘পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বিদেশি পরিবেশবাদীরা কাগজের কলম ব্যবহার করেন। সেখান থেকেই ধারণাটি পেয়েছি। তবে তাদের মতো মেশিনের উৎপাদনে না গিয়ে আমরা সম্পূর্ণ হাতে তৈরির উদ্যোগ নিই। এর পেছনে অন্যতম কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াতে হয়। আমরা সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেই কলম উৎপাদন করছি। অন্যদিকে একটি মেশিন ১০ জন শ্রমিকের কাজ একই সময়ে এককভাবে করতে পারে। আমরা ১০ জন নারীর কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে মেশিনের বদলে প্রান্তিক নারীর হাত দিয়েই কলম উৎপাদনের কাজটি চালিয়ে যাচ্ছি। ফলে বাজারের প্রচলিত প্লাস্টিকের কলমের সঙ্গে গ্রিন ইকোর উৎপাদিত কাগজের কলমের তুলনা করলে আমরা এখানে অন্তত ৯৫ শতাংশ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পেরেছি। সেই সঙ্গে কলমে যুক্ত করেছি নানা ধরনের বৃক্ষের বীজ। কলম ব্যবহার শেষে কলমটি মাটিতে ফেলে দিলে বা পুঁতে দিলে কাগজটি মিশে যাবে মাটির সঙ্গে আর বীজ থেকে গজাবে একটি গাছের চারা।’
কুড়িগ্রামের নারীদের হাতেই উৎপাদন হচ্ছে গ্রিন পেন। এখন ২০ জন নারী নিয়মিতভাবে গ্রিন পেন তৈরির কাজে যুক্ত রয়েছেন। নতুন করে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন আরও ১৫ জন নারী। এ প্রসঙ্গে সঞ্জয় বলেন, ‘কুড়িগ্রাম দেশের অন্যতম দরিদ্র জেলা। তাই কলম উৎপাদনে আমরা কুড়িগ্রামকে বেছে নিয়েছি। অপর দিকে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পরিবারের নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ কাজে যুক্ত করা হয়েছে। নারীরা বাড়ির নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রকৃতিবান্ধব এই কলম তৈরির মাধ্যমে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছেন।’ গ্রিন ইকোর পরিচালক আরও জানান, সবুজ অর্থনীতির সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিকে সামনে রেখে কলম উৎপাদন, বিপণন এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মানুষ অভ্যাসগত কারণেই প্লাস্টিকের কলম ছেড়ে কাগজের কলম ব্যবহার করতে কম আগ্রহী। তবে খুব ধীরে হলেও মানুষ একটু একটু করে কাগজের কলম ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। ‘গ্রিন প্রডাকশন’ ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ক্রেতারা অর্ডার দিয়ে থাকেন এবং কুরিয়ারের মাধ্যমে সারাদেশে কলম সরবরাহ করা হয়। এরই মধ্যে কুড়িগ্রাম, রংপুর ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনলাইনে অর্ডার করে ক্রেতারা এই কলম কিনছেন। এমনকি এই কলম যুক্তরাষ্ট্রেও পাঠানো হয়েছে।
ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়াও বেশ ভালো। সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, ‘অনেকেরই প্রাথমিক পর্যায়ে ধারণা থাকে যে, কাগজের কলম হয়তো নরম ও ব্যবহার অনুপযোগী হবে; কিন্তু গ্রিন পেন হাতে পেয়ে তাদের এ ধারণা পাল্টে গেছে বলে অনেকেই জানিয়েছেন। অনেকে মতামত জানিয়েছেন, বাজারের প্রচলিত প্লাস্টিকের কলমের চেয়ে কাগজের এই গ্রিন পেনের ব্যবহার আরামদায়ক।’ ভালো মানের বীজ দেওয়া, কলমের মান ঠিক রাখা, মেশিনের ব্যবহার না করে হাতেই উৎপাদন করা ইত্যাদি কারণে এর উৎপাদন খরচটা একটু বেশিই হয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম, লোগো ব্যবহার করতে চাইলে কাস্টোমাইজ খরচ যুক্ত হয়। সব খরচ সমন্বয় করে খুব অল্প লাভেই গ্রিন পেনের দাম নির্ধারণ করা হয়। এখন যে কলম উৎপাদন করা হচ্ছে, সেখানে তিন ধরনের কলম রয়েছে– ১০ টাকা, ১২ টাকা ও ১৫ টাকা দামের বলে জানান সঞ্জয় চৌধুরী। প্রসঙ্গত, প্রতি এক হাজার গ্রিন পেন বিক্রির লভ্যাংশ থেকে ১০টি গাছের চারা কিনে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে গ্রিন ইকো। গ্রিন ইকোর একটি স্বপ্ন হলো– শুধু বিপণন নয়, প্রাথমিক পর্যায়ে রংপুর বিভাগের ৮ জেলার ১ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে কাগজের কলম তুলে দেওয়া। সে ক্ষেত্রে অবশ্য পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। আবার দেশের বাজারে কাগজের কলমের প্রসারের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির স্বপ্নও রয়েছে তাদের। উন্নত দেশগুলো কাগজের কলম ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে; ফলে দেশের বাইরে এই কলম রপ্তানির সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিবেশ সচেতন প্রজন্ম তৈরির বিষয়টিও গ্রিন পেনের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করেন সঞ্জয় চৌধুরী। এ পরিবেশবাদীর মতে, ‘একজন শিক্ষার্থী ছোটবেলা থেকে কাগজের তৈরি কলম ব্যবহার করার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠবে। কাগজের কলম ব্যবহারের সময় অবচেতনভাবেই পরিবেশ সচেতনতার বিষয়টি তার মাথায় ঢুকে যাবে। হয়তো দীর্ঘ সময় পর একটা প্রজন্মের অধিকাংশই হবে পরিবেশ সচেতন।’