অর্থভুবন ডেস্ক
জেএসসিতে খারাপ ফলের কারণে লোকজনের কথা কম শোনেননি। হতাশায় একসময় আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন। সেই ইমরান হোসেন এখন আমেরিকার জনপ্রিয় ভাষা শেখার অ্যাপ এলসা স্পিকের প্রডাক্ট ডিজাইনার। মাত্র ২১ বছর বয়সেই নাম লিখিয়েছেন কোটিপতির তালিকায়।
২০১৫ সালের কথা। তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। জেএসসি পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। খুব মন খারাপ হয়।
ছোটবেলা থেকেই বড় শখ ছিল পাইলট হব।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা মাত্র ২৫ হাজার টাকা দামের একটি ল্যাপটপ কিনে আনেন বাসায়। এরপর কিভাবে অনলাইন থেকে আয় করা যায় এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু করি।
এটি এতই ভালো লাগতে শুরু করে যে দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় দিতে থাকি গুগল, ইউটিউবে। এমনকি এসএসসি পরীক্ষা চলার সময়ও ডিজাইনের কাজ শেখা বন্ধ করিনি। তখন আমার বয়স মাত্র ১৬ বছর। এসএসসি দিয়েছি দুই মাসও পার হয়নি। ইউএক্স ডিজাইনার হিসেবে চাকরি পেলাম দেশের একটি ডিজিটাল এজেন্সিতে। বেতন মাত্র আট হাজার টাকা। চাকরি পাওয়ার পর মনে হলো এসএসসির ফল খারাপ হলেও বলতে পারব আমি একটি চাকরি করি। কিন্তু সেবার অন্য সবার মতো আমার ফলও ভালো আসে।
শুরু থেকেই চেয়েছি ফ্রিল্যান্সিং করতে। মানে বিদেশি ক্লায়েন্টের সঙ্গে কাজ করে ডলার আয় করতে। তাই চাকরির পাশাপাশি চেষ্টা করতাম কিভাবে বিদেশি ক্লায়েন্ট পেতে পারি। তখন ড্রিবল (Dribbble), বিচান্স (Bechance), লিংকডইন (Linkedin), প্রিন্টারসসহ (Printers) বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরমে পোর্টফোলিও বানিয়ে প্রতিনিয়ত আমার কাজ সেখানে আপলোড করতে শুরু করি। ২০১৯ সালের শুরুতে প্রথম ফ্রিল্যান্সিং ক্লায়েন্ট পাই ড্রিবল থেকে। ৩০০ ডলারের প্রজেক্ট। আমার বয়স মোটে ১৭ বছর। ফলে আমার জাতীয় পরিচয়পত্র বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। সেই ৩০০ ডলার আনতে বাবার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হয়। হঠাৎ অ্যাকাউন্টে এতগুলো টাকা এলো দেখে মা-বাবা একটু চিন্তায় পড়ে যান।
যা হোক, এরপর আর আমাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। একের পর এক ক্লায়েন্ট পেতে থাকি। এক পর্যায়ে দেশের ডিজিটাল এজেন্সির চাকরি ছেড়ে দিলাম। তখন সব সময় আমার তিন-চারটি প্রজেক্টের কাজ চলত। কাজের নেশা পেয়ে বসল আমাকে। পড়ালেখা, বন্ধুবান্ধব, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজে মন দিলাম। এমনও অনেক দিন গেছে, মাত্র দু-তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছি এবং মাসে দু-একবার ঘর থেকে বের হতাম। তখন মাসে গড়ে দেড় লাখ টাকার মতো আয় হতো। এক পর্যায়ে ঠিক করলাম, দু-তিন সপ্তাহের একটি বিরতি নেব। তবে বিরতি থেকে ফেরার পর দেখলাম ক্লায়েন্ট কমে যাচ্ছে। দেড় লাখ টাকা থেকে হঠাৎ আমার আয় মাত্র ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় নেমে আসে। আবার হতাশ হয়ে পড়ি। কিছুতেই আগের মতো স্পেস পাচ্ছিলাম না। বুঝলাম ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের শুরুতে একটি বুস্টার হতে পারে, কিন্তু ক্যারিয়ার হিসেবে এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
পরের বছর দেশের বিভিন্ন কম্পানিতে ইউএক্স ডিজাইনার হিসেবে আবেদন করি। ১৪টি কম্পানি থেকেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। বেশির ভাগ কম্পানি আমার দক্ষতার ওপর খুশি, কিন্তু বয়স কম বলে আমাকে বিবেচনায় নিচ্ছিল না। তাদের ধারণা, মাত্র ১৮ বছর বয়সী একটি ছেলে কাজ করলে অফিসের বাদবাকি বয়স্ক কর্মকর্তারা হতাশ এবং লজ্জিত হবেন। অনেকের হয়তো আমাকে কলিগ হিসেবে মেনে নিতেও কষ্ট হবে! যা হোক, এরপর দেশের বাইরে কাজের চেষ্টা করি। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চাকরি পেলাম জাপানের একটি Ed-tech কম্পানিতে। বেতন এক হাজার ৩০০ ডলার। ভাষাগত সমস্যা এবং যোগাযোগ অদক্ষতার কারণে অচিরেই বুঝতে পারলাম চাকরিটি পরিবর্তন করা দরকার। পরের বছর জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক একই ধরনের কম্পানিতে প্রডাক্ট ডিজাইনার হিসেবে যোগদান করি আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেতনে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় তিন লাখ টাকা বেতনে অস্ট্রেলিয়ার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান Vool Studio-তে একজন সিনিয়র প্রডাক্ট ডিজাইনার হিসেবে যুক্ত হলাম। সেখানে চাকরির সুবাদে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ মেলে। ২০২২ সালের মে মাসে অন্যতম জনপ্রিয় ইংলিশ শেখার অ্যাপ এলসা স্পিকে (Elsa Speak) প্রডাক্ট ডিজাইনার হিসেবে কাজের অফার পেলাম। অফারটি লুফে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবিনি। এখনো সেখানেই কাজ করছি। ফুলটাইম জব। ঘরে বসেই আমেরিকান কম্পানির কাজটি চালিয়ে যাচ্ছি। এখানে আমার কাজ প্রডাক্ট ডিজাইনার করা। এলসা স্পিক মূলত সহজে ইংরেজি ভাষা শেখার একটি অ্যাপ। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০ লাখ মানুষ এটি ব্যবহার করছে। মূলত কিভাবে এই গ্রাহকদের আরো সহজে ভাষা শিখতে সহায়তা করা যায়, সেই কাজটিই আমি করি। গ্রাহক যদি কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়, সেগুলো নিয়ে গবেষণা করে সমাধান বের করি। পাশাপাশি নতুন ব্যবহারকারী আকৃষ্ট করার মাধ্যমে এলসার ব্যবসা বাড়াতে সহায়তা করি। এককথায়, কিভাবে খুব সহজে অ্যাপের মাধ্যমে ইংরেজি শেখা যায় গবেষণার মাধ্যমে এর নতুন নতুন উপায় বের করতে কাজ করেন প্রডাক্ট ডিজাইনাররা। এলসাতে কাজের পাশাপাশি নিজের একটি ডিজাইন টিম তৈরি করেছি যারা আমার ফ্রিল্যান্সিং প্রজেক্টগুলো দেখভাল করে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার আয় এক কোটি ছাড়িয়েছিল। একসময় আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করা এই আমার কাছেও বিষয়টি অবিশ্বাস্য লাগছিল!
এখন আমি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। এলসা স্পিকে কাজের পাশাপাশি একদল তরুণকে নিয়ে একটি ডিজাইনার টিম তৈরি করেছি, যারা কাজ করছে বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং প্রজেক্টে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইউএক্স ডিজাইন এজেন্সি গড়ে তুলতে চাই। পাশাপাশি দেশের আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে এমন একটি কমিউনিটি গড়ে তুলতে চাই, যারা তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে রোল মডেল হবে।
আরেকটি কাজ করার খুব ইচ্ছা আছে। সমাজ এখন ছাত্র-ছাত্রীদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে পড়ালেখা করে শুধু এ প্লাস পাওয়াই মুখ্য কাজ। আমি এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে চাই। বোঝাতে চাই, পড়ালেখার পাশাপাশি ছোট ছোট স্কিল ডেভেলপমেন্ট করলে পরে চাকরির বাজারে যুদ্ধ করতে হবে না।