অর্থভুবন প্রতিবেদক
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর আর্থিক প্রতারণা বেড়েছে বহুগুণ। সবচেয়ে বেশি শোনা যায় মূল্যবান উপহার পাঠানোর নামে ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা। একই কৌশলে বছরের পর বছর বহু মানুষ প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে অবাক হন অনেকেই। আর এমন প্রতারণা নিয়ে আলোচানা উঠতেই চলে আসে বিপ্লব লস্করের নাম, যিনি লোভ দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন বহু মানুষের। বেশি পরিমাণে টাকা হারানো ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু কিছুদিন পরই জামিনে বেরিয়ে বিপ্লব ফের শুরু করেন প্রতারণা। অবশ্য নাছোড়বান্দা এই প্রতারকের মূলোৎপাটনে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কয়েক বছর ধরে তদন্ত করে তার জমি, বাড়ি, নগদ টাকাসহ প্রায় ১৩ কোটির অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছেন সিআইডি কর্মকর্তারা।
সিআইডির তদন্তকারীরা বলছেন, প্রায় ১০ বছর প্রতারণা করে শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন প্রতারক বিপ্লব লস্কর। প্রতারণার টাকায় নিজের নামে জমি কেনা ও বাড়ি বানানোর প্রমাণও মিলেছে। বিপ্লব লস্কর প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া টাকা লুকাতে অন্যের ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন। এ জন্য দিয়েছেন মোটা অঙ্কের লাভ। এ ছাড়া অন্যের পরিচয়ে খোলা ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন টাকা। তদন্তে এভাবে আড়াল করা ৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে। তবে তার প্রতারণা থেকে আয় এর চেয়ে বেশি হতে পারে। সিআইডির মুখপাত্র অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান অর্থভুবনকে
বলেন, ‘এই প্রতারক চক্রটির বিরুদ্ধে আমাদের তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, তাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া হাতিয়ে নেওয়া অর্থ জব্দ করা হয়েছে।’
যেভাবে হাতিয়ে নিল এত টাকা : মানিকগঞ্জের মো. সাব্বির হোসেন পেশায় প্রকৌশলী, কাজ করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বিপ্লব চক্রের ফাঁদে পড়ে হারিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর নারী সদস্য পরিচয়ে তার সঙ্গে কথিত বন্ধুত্ব গড়ে তুলে উপহার হিসেবে নগদ অর্থ পাঠানোর নামে হাতিয়ে নেওয়া হয় এই টাকা।
সাব্বির অর্থভুবনকে বলেন, ‘ওই নারী আমার সাথে ফেসবুকে বন্ধুত্ব করেছিল। আমিও তার সাথে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, তার মাধ্যমে বিদেশে যাব এমন পরিকল্পনা থেকে। অনেক দিন কথার একপর্যায়ে সে জানায়, এক যুদ্ধে সে অংশ নিয়েছে এবং সেখানে অনেক নগদ টাকা পেয়েছে। এই টাকাগুলো সে নিরাপদে রাখতে পারছে না। আমার কাছে পাঠানোর কথা বলে। আমি তার কথায় রাজি হওয়ার কিছুদিন পর কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়ে আমাকে এক ব্যক্তি ফোন করেন। তিনি বলেন, আপনার মাল খালাসের জন্য ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। তার কথামতো টাকা দেওয়ার পর বুঝতে পারি এটা প্রতারণা।’
এমন অন্তত ১০ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তাদেরই একজন হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের বাসিন্দা তানজিলা আক্তার লুনা। সিঙ্গাপুরপ্রবাসী এক আত্মীয়কে ল্যাপটপসহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পাঠাতে বলেছিলেন। এর কিছুদিন পর তার কাছে ফোন আসে কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়ে। এরপর তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
তানজিলা অর্থভুবনকে বলেন, ‘দেবরের সাথে (সিঙ্গাপুরপ্রবাসী) কথা বলার কিছুদিন পর আমাকে একটি নম্বর থেকে ফোন করে কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়ে আমার উপহার এসেছে বলে জানায়। আমি দেবরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু তখন কোনো কারণে তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু আমার নামে উপহার এসেছে, সেটা পেতে আগ্রহী হয়ে উঠি। তাদের শর্ত অনুযায়ী ২৮ হাজার টাকা দিই। কিন্তু উপহারটি না দিয়ে তারা আমাকে বলে আপনার প্যাকেটে অবৈধ জিনিস পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় মামলা হলে আপনি এবং আপনার দেবর আসামি হবেন। এরপর আমি আরও ১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা দিই। এরপর ওই নম্বর বন্ধ পেয়ে বুঝতে পারি এটা প্রতারণা।’
বিপ্লব লস্করের চক্রটি এভাবে বিদেশ থেকে পার্সেল ও উপহার পাঠানোর নাম করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করত। প্রায় ১০ বছর আগে নাইরেজিয়ার একটি প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে এই প্রতারণার কাজ শুরু করে। এরপর কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে টাকা হাতিয়ে নিতেন। তার এই চক্রে জড়িত বাংলাদেশে বসবাসকারী নাইজেরীয় প্রতারকরা গ্রেপ্তার হয়েছে বিভিন্ন সময়। যাদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও চাকরিজীবীদের টার্গেট করে ফেসবুকে বন্ধুত গড়ে তুলত। পরে ডলার ও দামি উপহার পাঠানোর নামে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিত লাখ লাখ টাকা।
শূন্য থেকে কোটিপতি : বিপ্লবের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। পরিবারে অভাবের কারণে স্কুলে যাওয়া হয়নি। তবে তিনি প্রতারণায় জড়িয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। প্রতারণার অভিযোগে সারা দেশে তার নেতৃত্বাধীন চক্রটির বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশ তদন্ত করেছে পুলিশের বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এই চক্রের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে। এ ছাড়া সিআইডি বাদী হয়ে চারটি মামলা করেছে। অর্থ পাচার আইনে করা এসব মামলায় উঠে এসেছে বিপ্লব লস্করের অবৈধ সম্পদের তথ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, তদন্তে এখন পর্যন্ত বিপ্লব লস্করের ১২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার বেশি অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তার ও সহযোগীদের ব্যাংক হিসাবে পাওয়া যায় ৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা। আর একটি জমিসহ বাড়ি পাওয়া গেছে, যার আনুমানিক দাম তিন কোটি টাকা। গত বছর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকায় ওই জমি কেনেন এক চিকিৎসকের কাছ থেকে। এই বাড়িতেই স্ত্রীসহ থাকতেন।
সিআইডির করা মামলাগুলোয় বিপ্লব ছাড়াও অন্য আসামিরা হলেন মো. হামিদুর রহমান, রুমা আক্তার, মো. আলাল হোসেন, মো. শহিদুল ইসলাম, মো. হেলাল মিয়া, মো. হারুন অর রশিদ, কাউছার, মো. শাহিন, নাফিসা নওরিন ঐশী, লতা আক্তার, আয়েশা আক্তার, মো. হাবিবুর রহমান, মো. আশরাফুল ইসলাম ও মো. আল আমিন।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, হামিদুর রহমানকে বিপ্লব লস্কর হাতিয়ে নেওয়া টাকা থেকে প্রতি লাখে ১৫ হাজার লাভ দিতেন। এ জন্য তার পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে হাতিয়ে নেওয়া টাকা সরিয়ে নেওয়ার কাজ করতেন। তার স্ত্রী রুমা কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয়ে মানুষকে ফাঁদে ফেলার কাজ করতেন। বিপ্লবের চক্রে থাকা এই প্রতারক দম্পতি নিজেদের ভোগবিলাসে প্রতারণার অর্থ ব্যয় করেছেন।
অন্য আসামি আলাল হোসেন হামিদুরের অ্যাকাউন্ট থেকে চেক ব্যবহার করে টাকা তুলে মূলহোতা বিপ্লবের কাছে পৌঁছে দিতেন। এ জন্য আনুপাতিক হারে টাকা পেতেন। অন্যদিকে আসামি হারুন অর রশিদ ফেসবুকে মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার কাজ করতেন। এ জন্য বিভিন্ন অঙ্কের টাকা পেয়েছেন। চক্রের অন্য সদস্যরাও বিভিন্ন পন্থায় সাধারণ মানুষের ফেসবুক আইডি, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ও ই-মেইল অ্যাড্রেস সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করে টার্গেট করা ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। একপর্যায়ে দামি উপহার, স্বর্ণ, মূল্যবান পাথর, হীরা ও বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর কথা বলে ফাঁদে ফেলতেন।