অর্থভুবন ডেস্ক
মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনার পরে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীরই সাধ আর সাধ্যের সমীকরণ মেলে না। স্বপ্ন আর বাস্তবের এই টানাপড়েন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অথচ শিক্ষক, অভিভাবক, পেশাদার পরামর্শদাতার সহায়তায় লক্ষ্য পুনর্নির্ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব জীবনযুদ্ধে।
শুরুটা হয় শিক্ষাজীবনের শুরুতেই, ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ বা ‘বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও’ ধরনের বাংলা ও ইংরেজি রচনা বা অনুচ্ছেদ লেখার মাধ্যমে। নোটবই মুখস্থ করার কারণে বা শিক্ষকের পরামর্শে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে লেখে চিকিৎসক হওয়া বা প্রকৌশলী হওয়া। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু এই অনুশীলন চলতে থাকে মাধ্যমিক পর্যায় পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকেও। ফলে শিক্ষার্থীদের ধ্যানজ্ঞান থাকে শুধু চিকিৎসক হওয়া বা প্রকৌশলী হওয়া। চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার জন্য মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ নেওয়া অত্যাবশ্যকীয়। ফলে যারা বাণিজ্য বিভাগ বা মানবিক বিভাগ বেছে নেন তারা বাস্তবিক কারণে চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার লক্ষ্য পরিত্যাগ করলেও মনে মনে বেছে নেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ব্যাংকার, আইনজীবী বা সরকারি চাকরির বনেদি কোনো পেশাকে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সময় বাধে বিপত্তি। চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমিত সংখ্যক আসন। ফলে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার পরও বাস্তবিক কারণেই চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় না। অনেকেই বাধ্য হন বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হতে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয় থাকলেও শিক্ষার্থীদের উৎসাহ বেশি দেখা যায় কম্পিউটার প্রকৌশল, ফার্মেসি, তথ্যপ্রযুক্তি, ইইই, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিষয়ে পড়ার। অপরদিকে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আইন ইত্যাদি বিষয়কে তাদের পছন্দের প্রথম সারিতে রাখেন। কিন্তু প্রতিটি বিষয়েই আসন সংখ্যা চাহিদা অপেক্ষা কম হওয়ায় প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থীর মনোবাসনা অপূর্ণ থাকে। কমবেশি আঠারো বছরের লালিত স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। যার প্রভাব পড়ে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে, শিক্ষাজীবনে, পারিবারিক জীবনে। নিজের ও পরিবারের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার কারণে বিপর্যস্ত হয় শিক্ষার্থীর জীবনের এই তিন অংশ। এই চিত্র এতই ভয়াবহ যে, শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপ নিতেও কসুর করে না। অথচ জীবনের লক্ষ্য পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পেশাদার পরামর্শদাতার যৌথ উদ্যোগ।
সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি
পেশাজীবনে সফল হওয়ার জন্য নিজের কাজের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া প্রথম শর্ত। এ কারণে পছন্দের বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যিনি প্রকৌশল বিদ্যা সম্পর্কে আগ্রহী নন তিনি প্রকৌশল বিদ্যায় সুচারুরূপে জ্ঞান লাভও করতে পারবেন না। ভালো প্রকৌশলী হওয়াও তার জন্য কঠিন। পছন্দের বিষয়ে বেশি সময় ধরে নিবিষ্ট থাকা যায়। সফলতা তাই সহজেই আসে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার্থীর আগ্রহ অপেক্ষা বিভিন্ন গণমাধ্যম, চাকরি পাওয়ায় নিশ্চয়তা, অভিভাবকদের আগ্রহ, শিক্ষাব্যয় ইত্যাদি প্রভাবক শিক্ষার্থীর পছন্দের বিষয় নির্ধারণ করে। তাই কম্পিউটার প্রকৌশল, ফার্মেসি, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষার্থী পড়ার সুযোগ না পেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। মানসিক দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েন শুরু হয় তখন থেকেই। এই মানসিক টানাপড়েন থেকে মুক্তি পেতে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে জানতে চাই লাইফ কোচ মো. মিরাজ হোসেনের কাছে। তিনি জানান, অনেকে মনমতো বিষয় না পেলে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। হতাশ হয়ে পড়েন। তা না করে যদি শিক্ষার্থীরা নিজ বিষয়ে কী কী সুযোগ আছে, ক্যারিয়ার গড়ার কোন ধরনের সুযোগ আছে সে বিষয়ে বিভাগীয় শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে তাহলে লাভবান হবে। অনেকে আবার বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনায় আর মনোযোগী হন না; তারা বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। বিসিএসের জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির দরকার আছে সত্য কিন্তু প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করতে হবে বিষয়টা এমন না। অ্যাকাডেমিক বিষয়ে বেসিক ধারণাগুলো সম্পর্কে বিসিএসে প্রশ্ন করা হয়। তাই এ বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় নেটওয়ার্কিংয়ের খুব ভালো জায়গা। মনমরা হয়ে না থেকে সিনিয়র ও ব্যাচমেটদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এগুলো পেশাজীবনে কাজে দেয়। বিভিন্ন সংগঠনে যুক্ত হলে নেতৃত্বগুণ বৃদ্ধি পায়, দলে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়। প্যারেন্টিক বিষয়ক গবেষক শ্যামল আতিক বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমাদের শিশুদের যদি কষ্টসহিষ্ণু করে গড়ে তোলা যায় তাহলে চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে ব্যবধান দেখা গেলেও তারা হতোদ্যম হয়ে পড়বে না। ছোটবেলা থেকেই তাদের নিজের কাজ নিজে করার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম আজাদ ছোটবেলা থেকেই ফাইটার বিমানের পাইলট হতে চেয়েছিলেন। তার সমস্ত পড়াশোনা ও অধ্যবসায় তিনি এ বিষয়ে নিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন ফাইটার বিমানের পাইলট হওয়ার জন্য নির্বাচিত হলেন না তখন তিনি হতাশ হয়ে পড়লেও লক্ষ্য পুনর্নির্ধারণ করে বিমান প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু করেন। এই লক্ষ্য পুনর্নির্ধারণই তাকে ভারতের ‘মিসাইল ম্যান’ হিসেবে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। তাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে সম্মানিত করেছিল। তাই জীবনের লক্ষ্য যা-ই হোক না কেন যদি তা অর্জনে বাধা আসে তবে হতাশ না হয়ে লক্ষ্য পুনর্নির্ধারণ করে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়াই সফলতার চাবিকাঠি।