অর্থভুবন ডেস্ক
এমন এক সময় ছিল, যখন ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাটকে ঘিরে ছিল রমরমা ব্যবসাবাণিজ্য। দেদার পাট রপ্তানি হতো বিদেশে। এক কথায় বলা যায়, দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি ছিল পাট। জন্মসূত্রে আমার বেড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দরে। খরস্রোতা নদ ব্রহ্মপুত্রের তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা চিলমারী বন্দর। কী এক অভূতপূর্ব কর্মচাঞ্চল্য চিলমারী বন্দরের। ছোট-বড় পাট ব্যবসায়ীদের সুবিশাল পাটের গুদাম। পাট যাচাই-বাছাই করে পাটকলে বেল করে দেশের নানা প্রান্তে পাঠানো হতো। ভোর হলেই সপ্তাহের দুদিন বিভিন্ন এলাকার পাটচাষিরা পাট নিয়ে হাটে আসতেন। বেচাকেনা হতো। তারপর পাট চলে যেত গুদামে। ‘মাড়োয়ারি’ নামে খ্যাত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিল এই বন্দরে। তখন পাকা রাস্তা জেলা শহরেও চোখে পড়ত না। একমাত্র ভরসা, গরুর গাড়িতে পাট আনা-নেওয়া। এরপর পাটের রাজধানী নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাটভর্তি বড় বড় পানশী নৌকা চলে যেত, চিলমারী বন্দরের ঘাট ছেড়ে। আজ সবই স্মৃতি। ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দরের পাটের সেই ভরা যৌবন এখন আর চোখে পড়ে না।
পাটের সেই সোনালি দিন এখন অতীত। পাটচাষিরা এখন পাটের চাষ করলেও তেমন উৎসাহ পায় না। কারণ কোনো বছর পাটের দাম ভালো পেলেও কোনো বছর পাট চাষের খরচও ওঠে না। ফলে কমে গেছে পাট চাষ। আর পাটকল তো দেশে তেমন একটা নেই। এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজিকে চারদলীয় জোট সরকার, বিদেশিদের প্রিসক্রিপশনে বন্ধ করে দিয়েছিল। যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। শেষ পর্যন্ত চোখের পানিতে বিদায় নিতে হয়েছে চিরচেনা আদমজি থেকে। কথা ছিল, আদমজি বন্ধ করে সেখানে আরও বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে ওয়াদা বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর বিশেষ প্রয়োজনে ছোট ছোট পাটকল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলোর অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই। ফলে পাটচাষিরা গত ক’বছর ধরে পাটের ভালো দাম পেলেও, এ বছর পাটের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না। যদিও পাট বিক্রি করে পাটচাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে না। তবে লাভের মুখও দেখছে না। অর্থাৎ পাট চাষের উৎসাহ একসময় পাটচাষিরা হারিয়ে ফেলবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে পাটশিল্পের দুর্দিন আসবে, যা অনেকটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এমনিতেই পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি অনেক কমে গেছে। এর ওপর আবার প্রতিবেশী দেশ ভারত পাট ও পাটজাত পণ্যের উচ্চ হারে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে ভারতে পাটজাত পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করায় ভারতের বাজারে প্রতিযোগিতায় টেকা আর সম্ভব হচ্ছে না। কারণ নিজেদের পণ্যের বাজার নিশ্চিত করতে যে কোনো দেশ, বিদেশি পণ্যের বাজার নিরুৎসাহিত করবে এটাই স্বাভাবিক। এতে শঙ্কার কিছু নেই, কারণ বিশ্বের সেরা মানের পাট বাংলাদেশেই উৎপন্ন হয়। বিশ্ববাজারের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচাপাট এবং প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পাটজাত পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়। এখনো পাট খাতের বৈ ক রপ্তানি আয়ের ৭২ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। এমনকি একক কৃষিপণ্য হিসেবে বর্তমানে জাতীয় রপ্তানি আয়ের পাট খাতের বিশেষ অবদান রয়েছে। পাট অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জিডিপিতে এ খাতের অবদান ২ দশমিক ৮ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। পাট অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বছরে দেশে ৮৫-৯০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে শুধু কাঁচা পাট রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আর এখন পাট থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হচ্ছে।
সূত্রমতে, পাট ও পাটজাত বর্জ্যরে সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব বিশেষ সোনালি ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। পাটের তৈরি জিনস (ডেনিম) সারা বিশ্বের ফ্যাশনসচেতন মানুষের নজর কেড়েছে। এখন পাট দিয়ে জিও টেক্সটাইল, পাটখড়ি থেকে ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল) এবং পাট পাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ জাতীয় পণ্য বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। শুধু তাই নয়, পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবিসহ নানা কাপড়ের পণ্য। এ ছাড়াও ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, জুতা, স্যান্ডেল, দরজা, পর্দার কাপড়সহ নানা গয়না। সেসব বিক্রি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব। অথচ অপার সম্ভাবনার এই খাতকে আমরা তেমন নজর দিচ্ছি না। ফলে হেলায়-অবহেলায় অপার সম্ভাবনার পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার হুমকিতে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে পাটজাত পণ্য থেকে বাংলাদেশ ৯১ দশমিক ২২ কোটি ডলার আয় করেছে। এর পরিমাণ আরও বৃদ্ধির সুযোগ ছিল, যা হাত ছাড়া হয়েছে তুরস্কের বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায়। পাট খাতের অন্যতম বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, আকিজ বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সূত্রে জানা গেছে, পাটপণ্যের সর্ববৃহৎ বাজার ছিল তুরস্ক। এই বাজারে দুই লাখ টনের চাহিদা এখন এক লাখ টনের নিচে নেমে এসেছে। দ্বিতীয় বৃহৎ বাজার ছিল চীন। ভারত বড় বাজার হলেও, বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় ভারতের বাজার এখন অনুকূলে নেই। পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার যে কোনো মূল্যে টিকিয়ে রেখে রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। আমরা সহজেই পাট ও পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারি। এ বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব, সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। আমরা যেন কোনোভাবেই আমাদের ঐতিহ্যের কথা ভুলে না যাই।
লেখক : কৃষি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক
ahairanju@gmail.com