অর্থভুবন ডেস্ক
‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। কাজেই বাণিজ্যে আমাদের আরো বেশি করে মনোনিবেশ করতে হবে। অনেক দিন ধরেই আমরা বাণিজ্য বলতে কেবল ট্রেডিং বুঝেছি। আমাদের মনোযোগ ছিল আমদানিতে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি খাত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। যদিও তৈরি পোশাক খাত এ লক্ষ্য ভালোভাবেই অতিক্রম করেছে। এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প সামনে এগিয়ে গেছে মূলত নন-ট্র্যাডিশনাল মার্কেট বা অপ্রচলিত বাজারের ওপর নির্ভর করে। প্রচলিত বাজারে যেখানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ, সেখানে অপ্রচলিত বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩১.৩৮ শতাংশ। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে পোশাকশিল্পের প্রধান বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বিকল্প বাজারে ঝুঁকেছেন ব্যবসায়ীরা।
তৈরি পোশাকের এই বিকল্প বাজারে রপ্তানির যে উল্লম্ফন তা মূলত হয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া ও তুরস্কের হাত ধরে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে রপ্তানি ছাড়িয়েছে শতকোটি ডলার। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি ‘বিলিয়ন ডলার’ ক্লাবে প্রবেশ করেছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে বৈশ্বিক মন্দায়ও দেশের পোশাক রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ছিল। সম্প্রতি ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাট ইউরোপে পোশাক আমদানির যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি চীনকে ছাড়িয়ে শীর্ষে পৌঁছেছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালের জানুয়ারি-নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৩৮ শতাংশ। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক অঞ্চলে রপ্তানির বাজার সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় অপ্রচলিত দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানির যে প্রবৃদ্ধি, তা বেশ ভালোভাবেই দৃশ্যমান। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যখন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় অর্থনৈতিক দুরবস্থা চলছে, ঠিক সে সময় এমন অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বেড়েছে। সেই বাজার ধরার চেষ্টা করতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কার মধ্যেও নিরাপদ বাজার খুঁজে ব্যবসা সচল রাখা এবং অপ্রচলিত বাজারে পণ্য রপ্তানিতে সরকারের ৪ শতাংশ প্রণোদনার সুবিধা নিতে নতুন করে অনেকেই এখন ইউরোপ-আমেরিকার বাইরের বাজারগুলোর দিকে ঝুঁকছেন। এরই সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৫৬টি দেশে মোট এক হাজার ৮৩৩ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে অপ্রচলিত দেশগুলোতে রপ্তানি হয়েছে ৩১৯ কোটি ডলার বা সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকার, যা মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ১৭.৪০ শতাংশ।
তবে খুব একটা উত্ফুল্ল হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং আশঙ্কার জায়গাগুলো আমাদের দৃষ্টিতে রাখতে হবে। শ্রোডার্স ও কর্নেল ইউনিভার্সিটির সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা আমাদের জন্য যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তীব্র দাবদাহ ও বন্যার কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ২৬.৭৮ বিলিয়ন বা দুই হাজার ৬৭৮ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় কম হতে পারে। তীব্র দাবদাহের কারণে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা যেমন কমবে, তেমনি অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে। ‘হায়ার গ্রাউন্ড : হাউ ফ্যাশন সাপ্লাই চেইনস আর বিয়িং ইমপেক্টেড বাই এক্সট্রিম হিট অ্যান্ড ফ্লাডিং’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে জলবায়ু অভিযোজিত পরিস্থিতিতে যদি তৈরি পোশাক খাত কর্মীদের তাপের চাপ কমাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়, তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি দাঁড়াবে ১২২.০১ বিলিয়ন ডলার।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষায় বাংলাদেশ যদি অভিযোজনব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? গবেষণায় বলা হয়েছে, তীব্র দাবদাহ ও বন্যার কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ রপ্তানি আয় কমে হবে ৯৫.২২ বিলিয়ন ডলার। ২০৫০ সাল নাগাদ এই আয়ের প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে কমবে।
তাহলে আমাদের করণীয় কী? নেতিবাচক সব প্রভাব কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি বিকল্প ও নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি বিকল্প বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ভালো এসেছে। এ ব্যাপারে বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো কার্যকর ও ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সক্রিয় বা প্রো-অ্যাক্টিভ হতে হবে। একটা গবেষণা সেল বোধ হয় এখন খুব বেশি দরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও নিজেদের উদ্যোগে একটি ব্যাবসায়িক গবেষণা সেল তৈরি করলে সেখান থেকেও আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@gmail.com