অর্থভুবন ডেস্ক
জনসচেতনতা সৃষ্টি ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে সরকার ‘জাতীয় স্থানীয় সরকার দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রথমে ১৬ জানুয়ারি ‘জাতীয় স্থানীয় সরকার দিবস’ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আগামী বছর জানুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচনের সময় থাকায় প্রতি বছর ১৪ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ দিবসটি ব্যাপকভাবে পালনের জন্য এ বছর ওইদিন গণভবনে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের, তথা ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর, অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মেয়র, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, গণভবনে ৮ হাজার জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে স্থানীয় সরকার দিবস উদযাপিত হয়েছে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার দিবসের স্লোগান ছিল ‘সেবা ও উন্নতির দক্ষ রূপকার, উন্নয়নে-উদ্ভাবনে স্থানীয় সরকার।’ মহা এ আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় কর্মসূচি সম্পন্ন করে নিজ নিজ কর্মস্থলে প্রত্যাবর্তন করে ১৭, ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর তিন দিনব্যাপী জাতীয় স্থানীয় সরকার দিবস উন্নয়ন মেলা আয়োজন করবে। মেলায় প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্যান্য স্থানীয় ইউনিটগুলো, স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন সব দফতর ও সংস্থা সরকারের বাস্তবায়িত উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরবে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে শহরের প্রধান সড়কগুলোতে ফেস্টুন ও ব্যানার দিয়ে সুসজ্জিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। দিবস উপলক্ষে দুই সিটিকে মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযানের জন্য কর্মসূচি নিতে বলা হয়। স্থানীয় সরকার হলো গাড়ির চাকার মতো। চাকা অচল হয়ে যাওয়া মানে গোটা গাড়ি অচল হয়ে যাওয়া। সে জন্য নির্বাচিত ও অনির্বাচিত কোনো সরকারই স্থানীয় সরকারকে অস্বীকার করে চলতে পারে না। তাছাড়া রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবনা এসেছে স্থানীয় শাসন থেকে। এখানে গ্রিসের নগর রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা যেতে পারে। প্রাচীন গ্রিসে প্রায় ১ হাজার ৫০০টি পলিস বা নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস পাওয়া যায়। নাগরিকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ও পরামর্শে নগর রাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হতো। তবে শিশু, মহিলা, দাস ও বহিরাগতরা নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতো না। নগর রাষ্ট্রগুলোতে জনগণের মিলন কেন্দ্র, উপাসনালয়, পণ্য ক্রয়-বিক্রয় স্থান, বিচারালয় ছিল। পরবর্তীতে বড় বড় নগর রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করে। জাতীয় রাষ্ট্র পরবর্তীতে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ইউরোপের অধিকাংশ দেশগুলোর ইতিহাস ঘাঁটলে একই চিত্র পাওয়া যায়। সেখানে সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটেছে বহু আগে; কিন্তু স্থানীয় সরকারগুলো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছে আগের মতোই, তথা সেখানে এখনো বটম-আপ পদ্ধতি (নিচ থেকে উপরমুখী) শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশেও এক সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু বহির্শক্তির বারবার আক্রমণের কারণে স্থানীয় রাজ্যগুলো উপযুক্তভাবে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। ব্রিটিশ সরকার দয়া করে কিংবা তাদের প্রয়োজনে স্থানীয় ইউনিটগুলোর জন্ম দেয়। দেশ স্বাধীন হলেও সে ধারা যে পুরোপুরি পাল্টেছে-তা বলা যাবে না। সরকার স্থানীয় সরকার দিবস পালনের কথা বলেছে বটে; কিন্তু সংবিধানে স্থানীয় শাসনের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। মজার বিষয় হলো- স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের কাছ থেকে স্থানীয় সরকার দিবস পালনের দাবিটি আসেনি, এটা এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে। এতেই প্রমাণিত হয় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা স্থানীয় সমস্যা নিয়ে ভাবেন না। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। তাছাড়া একটি মাত্র সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় এবং দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ায় প্রতিনিধিরা স্থানীয় সমস্যা বাদ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছেন। সে জন্য ‘সিডিএলজি’ দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছে এদেশের উপযোগী গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে হলে দুই প্রকারের সরকারব্যবস্থা, তথা কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। যেহেতু সংবিধানে স্থানীয় সরকার শব্দটি না থাকা সত্ত্বেও সবাই এ শব্দটি ব্যবহার করছেন, সে কারণে প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে ‘সরকার’ শব্দটি যুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে। যেমন- জেলা সরকার, উপজেলা সরকার, নগর সরকার ও ইউনিয়ন সরকার। জেলা সরকার হবে নগর সরকার (সিটি/পৌর) ও গ্রামীণ সরকারগুলোর (ইউনিয়নগুলোর) সর্বোচ্চ ইউনিট। কেন্দ্রের সঙ্গে শুধু জেলার সম্পর্ক থাকবে। জেলা একহাতে নগরীয় ইউনিট ও অন্য হাতে গ্রামীণ ইউনিটগুলো পরিচালনা করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সালের আগে কিংবা পিছে সমগ্র দেশটি নগর হয়ে যাবে। তখন গ্রামীণ ইউনিটগুলোর বিলুপ্তি ঘটবে (ফলে উপজেলারও বিলুপ্তি ঘটবে)। জেলার প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা যেতে পারে। সংক্ষেপে নগর সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা যেতে পারে। নগর প্রশাসন, নগর সংসদ ও নগর আদালত মিলে ‘নগর সরকার’ গঠিত হবে। নগর সরকারের বাইরে নগর ন্যায়পাল ও নগর নির্বাচনিক বোর্ড থাকবে। নগর ন্যায়পাল নগরবাসীর পক্ষে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবেন। দলীয়-নির্দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে নগর নির্বাচনিক বোর্ড গঠিত হবে।
লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক