অর্থভুবন ডেস্ক
প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সই দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। বাড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু এই প্রবাসীরাই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। যথাযথ মর্যাদা পান না। বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন দপ্তরে অনেক হয়রানির শিকার হন। তাই দেশের রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রবাসীদের গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রোববার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তৃতীয় গ্লোবাল বিজনেস সামিটে বক্তারা এসব কথা বলেন।
প্রবাসীদের অধিকার রক্ষায় এনআরবি সিআইপি অ্যাসোসিয়েশন দিনব্যাপী জাতীয় পর্যায়ে এই সম্মেলনের আয়োজন করে। সংগঠনের সভাপতি মো. মাহতাবুর রহমান নাসিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী বলেন, প্রবাসীরা আসলেই মর্যাদা পান না। আগামীতে তাদের সব ধরনের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেবে সরকার। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সার্ক চেম্বারের সভাপতি জসিম উদ্দিন, এনআরবি সিআইপি অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা পারভেজ তমাল, রূপায়ণ গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খান রাতুল, সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার, এনআরবি সিআইপি অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি তাথেইয়া কবীর, সহসভাপতি মো. মনির হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান খান, ইউনুস গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুস, বাংলাদেশে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আব্দুল্লাহ আলি আব্দুল্লাহ খাসেইফ আল হামুওদী প্রমুখ।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী আরও বলেন, প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু তারা যথাযথ সম্মান পান না। আমি মন্ত্রী হয়ে বলছি আপনাদের উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয় না। তবে এই মর্যাদা দেওয়ার দায়িত্ব আমার একার নয়। এখানে অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। তাদের সবাইকে প্রবাসীদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।
তিনি বলেন, বিমানবন্দরে প্রবাসীদের এক কাপ চা বা কফি দিলে কত টাকা খরচ হয় প্রবাসীদের আমরা দেশের জন্য ত্যাগ করতে বলি। কিন্তু যৌক্তিক কিছু বিষয় আছে। যেমন সরকারিভাবে আজকে ডলারের দাম ১১০ টাকা। কিন্তু হুন্ডিতে তা কেনা হচ্ছে ১১৭ টাকা ৫০ পয়সায়। অর্থাৎ প্রতি ডলারে পার্থক্য ৭.৫ টাকা। এটা বিশাল ব্যবধান। সে কারণে আমি বলছি বতর্মানে যে প্রণোদনা দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট নয়।
তিনি বলেন, প্রবাসীদের জন্য বিদেশে বিমার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এর প্রিমিয়াম একটু বেশি। এর পরও আশার কথা হলো মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে চাকরিদাতা বিমার প্রিমিয়াম দিয়ে দেয়। তিনি প্রবাসীদের সব ধরনের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির জন্য বুস্টার। আর প্রবাসীরা এই রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছেন। আমরা তাদের সমস্যার কথা জানি। এগুলো সমাধানে আমার পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা থাকবে।
মো. মাহতাবুর রহমান বলেন, আমাদের সমস্যাগুলো সরকারের লোকজন বোঝেন। কিন্তু কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ে জটিলতা আছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়নে চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ সমস্যা সৃষ্টি করছেন। তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার প্রবাসীদের যৌক্তিক দাবিগুলো বাস্তবায়ন করলে তাদের মাঝে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক বাড়বে। এতে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক বেড়ে যাবে।
বক্তারা বলেন, বর্তমানে বৈধভাবে রেমিট্যান্স আসছে ৪০ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশই আসে হুন্ডির মাধ্যমে। এই হুন্ডি বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রবাসীদের কল্যাণে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে-অসহায় প্রবাসীর মৃতদেহ সম্পূর্ণ সরকারি খরচে দেশে পাঠানো। যেসব প্রবাসী ২০ থেকে ৩০ বছর পরে দেশে ফেরত যাবে তাদের জন্য ভাতা চালু করা। প্রবাসী বিমা সচল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া। বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে বর্তমানে যে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে তার একটি অংশ প্রবাসীদের জন্য জমা রাখা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও বাড়াতে কোনো ধরনের সীমারেখা না রেখে ওয়েজ আর্নার বন্ড বিক্রয়ের জন্য সরকারের এগিয়ে আসা এবং ডলার সংকট নিয়ে গুজব বন্ধ করা।
সরকারি প্লট এবং ফ্ল্যাট ক্রয় করার ক্ষেত্রে প্রবাসীদেরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং স্বল্প সুদে প্রবাসীদের জন্য ঋণ দিতে হবে। প্রবাসীদের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করতে হবে। এতে অনেক ব্যবসায়ী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে। প্রবাসীদের ব্যাপারে সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী কমিটিতে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে এনআরবি সিআইপি অ্যাসোসিয়েশনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দাবির মধ্যে আরও আছে-বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রবাসীর সন্তানদের আলাদা কোটা রাখতে হবে। প্রবাসীদের বিদেশে বসে দূতাবাসের মাধ্যমে ভোটার আইডি কার্ড করার সুযোগ করে দিতে হবে। ইতোমধ্যে কিছু দেশে ভোটার আইডি কার্ড চালু করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
প্রবাসীদের বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করার প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। পাসপোর্ট করতে গিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। যেসব প্রবাসীর সন্তানরা বিদেশে জন্মগ্রহণ করে, তাদের জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন তুলে নিতে হবে।
প্রবাসীদের ছেলেমেয়েরা বিদেশের মাটিতে পডালেখার ক্ষেত্রে সরকারি খরচে স্কুল-কলেজের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। প্রবাসী অসুস্থ শ্রমিকদের দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পর্যায়ে তালিকা তৈরি করে নিু আয়ের প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশে বিমানবন্দরগুলোতে প্রবাসী হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সরকারের সব মন্ত্রণালয়ে প্রবাসীদের সার্ভিস দেওয়ার জন্য প্রবাসী সহায়তা-ডেক্স চালু করতে হবে। বিদেশের মাটিতে যেসব প্রবাসী উদ্যোক্তা বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন, তাদের বাংলাদেশে সামাজিক মর্যাদায় সম্মানিত করে উৎসাহিত করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত রেমিট্যান্স প্রেরণ করার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ থাকে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠালে তা পরিবারের কর্তাব্যক্তির নামে অন্তর্ভুক্ত করে সিআইপি আবেদন করার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রবাসীরা আয়কর দিতে গিয়ে অনেক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সহজ প্রক্রিয়ায় কর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বের সব দেশে দূতাবাসগুলোকে আরও গতিশীল করে হুন্ডি প্রতিরোধ করার জন্য প্রবাসীদের পরামর্শ গ্রহণ করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার জন্য জাতীয় সংসদে প্রবাসীদের প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে হবে।