অর্থভুবন ডেস্ক
রাঙামাটির বাঘাইছড়ির ভূইয়াছড়ার বাসিন্দা রুমেন চাকমা। মা-বাবা দুজনই দরিদ্র জুমচাষি। অনটনের সংসার। লজিং থেকে পড়েছেন কলেজে।
চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময় ভাবলেন, তাঁর মতো দরিদ্র ও মেধাবীদের বিনা পয়সায় পড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তৈরি করবেন। সেই ভাবনারই ফসল জুম একাডেমি।
গত তিন বছরে এই একাডেমি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ৮৪ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতজন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৯ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনজন, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তাঁরা।
যেভাবে শুরু
২০২০ সালের ১২ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জুম একাডেমি। এর বীজ অবশ্য বোনা হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেবার মোনঘর (রাঙামাটির শিশু সদন) থেকে এইচএসসি দেওয়া শিক্ষার্থী এবং টাকার অভাবে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে না পারা কয়েকজনকে পড়াতে শুরু করেন রুমেন চাকমা। তাঁর সঙ্গে পরে যোগ দেন নৃবিজ্ঞানের রিপন চাকমা ও বাংলা বিভাগের ইলি চাকমা।
এই সাফল্য দারুণ আশাবাদী করে তোলে রুমেনকে। ভাবলেন, বড় পরিসরে কাজটা করবেন। কিন্তু বাদ সাধে করোনা। বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধুবান্ধব সবাই নিজ নিজ বাড়িতে চলে যান। ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শ্রাবণ চাকমা, ভূগোল ও পরিবেশের নবোদয় চাকমাসহ তিন বন্ধুর সঙ্গে কটেজেই রয়ে যান রুমেন।
সেবার এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটো পাস দেওয়া হয়েছিল। পার্বত্য জেলাগুলো থেকে আসা অনেক শিক্ষার্থীরই ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে গিয়ে কোচিং করার সামর্থ্য ছিল না। এসব শিক্ষার্থীকে পড়িয়ে ছুটির এই অখণ্ড অবসর কাজে লাগানোর কথা ভাবলেন রুমেন। বিষয়টি নিয়ে শ্রাবণ ও নবোদয়ের সঙ্গে আলাপ করলেন। তাঁরাও সম্মতি দিলেন। তাঁরা সম্মিলিত এই উদ্যোগের নাম দিলেন জুম একাডেমি। স্লোগান ‘বুনোফুল ফুটতে থাকুক জুম পাহাড়ের বুকে।’
রুমেন বলেন, ‘আমার মতো বহু তরুণ আছে, যাদের মেধা আছে, ইচ্ছাশক্তি আছে; কিন্তু অর্থবল নেই। এমন শিক্ষার্থীদের কিভাবে সহযোগিতা করা যায় ভাবছিলাম। এটাই জুম একাডেমি চালুর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।’
জুম একাডেমির সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা শ্রাবণ চাকমা বলেন, ‘দুর্গম পাহাড় থেকে আসা শিক্ষার্থীদের আমরা দরদ দিয়ে গড়ে তুলি।’
আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা নবোদয় চাকমা বললেন, ‘শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজ বদলাতে চাই। তাই জুম পাহাড়ের বুকে বুনোফুল ফোটাতে তিন বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিশ্বশান্তি প্যাগোডা কর্তৃপক্ষসহ এ কাজে যাঁরা পাশে আছেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞ আমার।’
যেভাবে চলছে কার্যক্রম
প্রতিবছর এইচএসসির পর জুম একাডেমির ফেসবুক পেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তীচ্ছুদের নানা তথ্য চাওয়া হয়। পরে তা যাচাই-বাছাই করে আগ্রহীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন একাডেমির পরিচালকরা। কোচিংয়ের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের ক্যাম্পাসে থাকার ব্যবস্থাও করেন। প্রথম ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের কোর্স আউটলাইন প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার লিখিত অংশের প্রস্তুতির জন্য আলাদা সিলেবাস ও ক্লাস পরিচালনা করেন তাঁরা। কোর্সের মেয়াদ চার মাস। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে বিশ্বশান্তি প্যাগোডার দুটি কক্ষসহ মোট তিনটি কক্ষকে ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করেন তাঁরা। এ জন্য প্যাগোডা কর্তৃপক্ষকে কোনো ফি দিতে হয় না।
কারা পড়ান
বিজ্ঞান (এ ইউনিট), কলা ও বিভাগ পরিবর্তন (বি ও ডি ইউনিট), ব্যবসায় প্রশাসন (সি ইউনিট) ও নার্সিং—এই চারটি ইউনিটে ভাগ করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। প্রতিদিন দুই শিফটে দুই ঘণ্টা করে ক্লাস নেওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহে মূল্যায়ন পরীক্ষাসহ কোর্স শেষে তিনটি চূড়ান্ত মূল্যায়ন পরীক্ষাও নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পাহাড়ি ছেলেমেয়েরাই ক্লাস নেন। তাঁরা মেন্টর নামে পরিচিত। প্রতি ইউনিটের জন্য আলাদা মেন্টর থাকেন। এখন আছেন ৩৫ জন।
শুরু থেকেই জুম একাডেমিতে উচ্চতর গণিতের মেন্টর হিসেবে সেবা দিচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এন্টন চাকমা। তিনি বলেন, ‘যখন খবর পাই, আমার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে, তখন যেন সব কষ্ট নিমেষেই উবে যায়।’
প্রাণিবিদ্যার মেন্টর মিলিপ্রু মারমার কণ্ঠেও একই সুর, ‘যখন শুনি জুম একাডেমির শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, তখন আমার মধ্যে এক ধরনের অব্যক্ত আনন্দানুভূতি তৈরি হয়।’
ইংরেজি পড়ান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মুকুল চাকমা। তিনি বলেন, ‘একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযোগী করে গড়ে তোলার মধ্যে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি আছে।’
বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিনা মূল্যে পড়ার সুযোগ পায়। সামর্থ্যবানদের কাছ থেকে জনপ্রতি এক থেকে দেড় হাজার টাকা নেওয়া হয়। পরে তা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভর্তির কাজে লাগানো হয়। এখন শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকেও কিছু অনুদান পান রুমেনরা।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের বাইরে ক্যাম্পাস ছুটির সময় পার্বত্য তিন জেলার কলেজগুলোতে গিয়ে জুম একাডেমির সদস্যরা উচ্চশিক্ষা বিষয়ক কর্মশালা পরিচালনা করেন। ভর্তি পরীক্ষার সময়ও আগত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সহযোগিতা করেন।
উপকারভোগীদের কথা
রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দুর্গম ফারুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা রাভেন তঞ্চঙ্গ্যা। তাঁর গ্রামের নাম পশ্চিম মন্দিরাছড়া, যা রেংখ্যং নদীপথে রাঙামাটি শহর থেকে ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। রাভেনদের নিজেদের জায়গা-জমি নেই। মা-বাবা দুজনই দরিদ্র জুমচাষি। তাঁর গ্রামে সড়কপথে যাতায়াতের উপায় নেই। নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। নেই চিকিৎসাকেন্দ্র। পৌঁছায়নি বিদ্যুৎ। এত সব নেইয়ের মধ্যেও জুম একাডেমিতে কোচিং করে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। রাভেন বললেন, ‘জুম একাডেমি পাশে না থাকলে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা স্বপ্ন হয়েই রয়ে যেত।’
জুম একাডেমির প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন গৌতম খীসা। এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। তিনি বললেন, ‘মেন্টররা যেকোনো বিষয় আন্তরিকতার সঙ্গে বুঝিয়ে দিতেন। এটা ভর্তি পরীক্ষায় খুব কাজে দিয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্রী আয়না তঞ্চঙ্গ্যা বললেন, ‘এইচএসসির পর কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রস্তুতি নেব, বুঝতে পারছিলাম না। শহরে গিয়ে কোচিং করব, সেই অবস্থাও ছিল না। তখন বিনা পয়সায় পড়িয়ে জুম একাডেমি আমাকে আলোর পথ দেখিয়েছি।’
জুম একাডেমির তৃতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন বুদ্ধজীবন চাকমা। তিনি বললেন, ‘আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আমার। আমার মতো পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে জুম একাডেমির।’
শিক্ষা সহায়তা তহবিল
সামনে জুম একাডেমির ওয়েবসাইট ও অ্যাপস বানাতে চান বলে জানালেন রুমেন। যেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি সম্পর্কিত তথ্যাবলি, স্কলারশিপ, চাকরি, বই ও লাইভ পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকবে। পাশাপাশি শিক্ষা সহায়তা তহবিল গঠন করতে চান। তিনি বললেন, ‘ভর্তি যুদ্ধে জয়ী হলেও অনেকে অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারে না কিংবা নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হিমশিম খায়। বিত্তবানদের সহায়তায় তাদের জন্য শিক্ষা সহায়তা ফান্ড গঠন করব।’