অর্থভুবন ডেস্ক
মহামারির প্রভাব, দ্রুত নগরায়ণ, কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কর্মক্ষেত্রে যথাযথ পরিবেশ না থাকা ও জনসচেতনতার অভাবে কমছে ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের মাতৃদুগ্ধ পানের হার। ছয় মাসের পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুর জন্য ঘরে তৈরি প্রয়োজনীয় বাড়তি খাবার গ্রহণেও বড় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে শুরুতেই অপুষ্টিজনিত নানা সমস্যার শিকার হচ্ছে শিশু। গত ৩০ আগস্ট ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড (ইডাব্লিউএমজিএল) মিলনায়তনে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এসব কথা বলেন।
প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ওপর জোর দিতে হবে পুষ্টির দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে
ডা. মিজানুর রহমান
প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের সুবিধা হলো, প্রসবের পরপরই প্রথম ঘণ্টার মধ্যে আমরা বাচ্চাকে শালদুধ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করে দিতে পারছি। এই কাজটা বাড়িতে বা বাসায় সম্ভব হয় না। সেখানে সঠিক পরিবেশ থাকে না।
বিএমএস আইন আমরা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি
অধ্যাপক ডা. শাহ গোলাম নবী
বিএমএস (মাতৃদুগ্ধের বিকল্প) আইন আমরা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এই আইন বাস্তবায়ন করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন জনসচেতনতা। মা, পরিবার এবং যারা মাতৃদুগ্ধের বিকল্প খাদ্য তৈরি বা বিপণন করে তাদের সচেতন না করে আইনটি বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে। আইনটি আমাদের কোনো অংশীজনদের কাছেই ভালোভাবে পৌঁছেনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা এই ব্যর্থতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অবহিতকরণ সভা করব। এর জন্য এরই মধ্যে সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট বরাদ্দও পেয়েছি। বিষয়টি গণমাধ্যমগুলোকেও জানাতে চাই এবং এটির প্রচারে তাদের সাহায্য চাই। মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্যের উৎপাদন, বিপণন ও প্রচার সম্পর্কে এই আইনে সবই বলা আছে। বিকল্প খাদ্যের প্রচার কতটুকু করতে পারবে বা কতটুকু পারবে না তা বলা আছে। সবাই যখন আইনটি ভালোভাবে জানবে, তখন ভালোভাবে মানার চেষ্টা করবে।
তিন কাজে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব
ডা. মো. মনিরুজ্জামান
বাংলাদেশে প্রতিবছর ছয় লাখ শিশু অপরিণত বয়সে জন্মগ্রহণ করে। আর এসব অপরিণত বয়সে জন্ম নেওয়া শিশুর বেশির ভাগই কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এটির হার ২৩.৬ শতাংশ। এই শিশুরা পরে অপুষ্টিতে ভোগে। এর জন্য প্রথমে কিশোরী পুষ্টিসেবা নিশ্চিত করতে হবে। যেদিন থেকে গর্ভধারণ শুরু হবে সেদিন থেকেই গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির দিকে নজর দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে শিশুর জন্মের পর থেকে নবজাতক ও শিশুর খাদ্যের দিকে নজর দিতে হবে। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে শালদুধ খাওয়াতে হবে। এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং, অর্থাৎ ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাসের পর থেকে দুই বছর পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি বাড়তি খাবার খাওয়াতে হবে। এই তিনটি বিষয় সঠিকভাবে পালন করতে পারলেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। এসডিজি থেকে আমরা খুব বেশি পিছিয়ে নেই। খর্বকায়তায় ২৪ শতাংশে আছি, আগামী সাত বছর ২০৩০ সালের মধ্যে ১২ শতাংশের নিচে আনতে হবে। কৃশকায় ১১ শতাংশ আছে, সেটি ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া কম জন্ম ওজনের শিশুর হার কমাতে হবে।
শিশুর ব্রেইন সেল তৈরিতে প্রয়োজন মায়ের সুষম পুষ্টি
ডা. মোস্তাফিজুর রহমান
বাচ্চা যখন মায়ের গর্ভে থাকে তখন তার ব্রেইনের প্রতিটি সেল (কোষ) তৈরি হয়। পৃথিবীতে এলে আর কোনো সেল তৈরি হয় না। বাচ্চা যখন পৃথিবীতে আসে তখন ১০০ বিলিয়ন ব্রেইন সেল নিয়ে আসে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশের কোনো সংযোগ থাকে না। বাচ্চাকে যদি মায়ের দুধ খাওয়ানো হয় তাহলে ক্রমেই বাকি সেলগুলোর কানেকশন তৈরি হতে থাকে। বাচ্চা যখন মায়ের পেটে থাকে তখন তার মায়ের কাছ থেকে সব পুষ্টি পায়। কাজেই বাচ্চার ব্রেইন সেল তৈরি করতে গেলে মাকে সুষম পুষ্টির বিষয়টি বুঝতে হবে। এ জন্য গর্ভাবস্থায় একজন মাকে কত শতাংশ শর্করা, আমিষ, প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ ও পানি খেতে হবে—এ বিষয়টি মা ও বাবাদের বোঝাতে হবে। আমাদের গর্ভবতী মায়েরা অনেক সময় নানাভাবে মানসিক অত্যাচারের শিকার হন। মনে রাখতে হবে, গর্ভাবস্থায় যদি মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হয় তাহলে বাচ্চার অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই এই সময় মায়ের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে। তাকে মানসিক প্রশান্তির মধ্যে রাখতে হবে। মায়ের পুষ্টির যত্ন নিতে হবে। তাহলেই একটি সুস্থ বাচ্চা পৃথিবীতে আসবে।
শিশুকে তিন বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ নিয়মিত খাওয়াতে হবে
ডা. এস কে রায়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৬ সালে ঘোষণা করেছে, শিশুকে তিন বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ নিয়মিত খাওয়াতে হবে, দুই বছর পর্যন্ত নয়। এ তথ্যটি আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে এখনো ভালোভাবে পৌঁছায়নি। এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং শিশুর শতভাগ পুষ্টির নিশ্চিয়তা দেয়। সেটিকে আরো বাড়াতে হবে।
২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড ব্রেস্টফিডিং ট্রেন্ডস ইনিশিয়েটিভ (ডাব্লিউবিটিআই) বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোতে বিশ্বের ৯৮টি দেশের মধ্যে ৯১.৫ নম্বর পেয়ে বাংলাদেশ প্রথম স্থান অর্জন করে। বহু বছর প্রথম স্থান অবস্থানকারী শ্রীলঙ্কাকে মাত্র ০.৫ নম্বরে আমরা হারিয়েছি। সে জন্য জন্য আমরা যে খুব নিরাপদ অবস্থানে আছি তা নয়। করোনা মহামারি ও অন্য আরো কিছু কারণে ২০২২ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, আমাদের এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিংয়ের হার ১০ শতাংশ কমে যায়। ১৯৮৯ সালে দেশের এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং ছিল মাত্র ১২ শতাংশ। বস্তিগুলোতে এই হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। সেই হিসাবে আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পেরেছি। সে জন্য আমাদের শিশুদের জন্য ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ ও পরে এর পাশাপাশি ঘরে তৈরি অন্যান্য পরিপূরক খাবারকে উৎসাহিত করতে হবে। মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্যের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর জন্য মাতৃদুগ্ধ বিকল্প ও শিশুখাদ্য আইনটিকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় পুষ্টি সেবা, স্বাস্থ্য, মহিলা ও শিশুবিষয়ক, শ্রম ও কর্মসংস্থান, বাণিজ্য, তথ্য ও আইন মন্ত্রণালয় সবার সমবেত সহায়তা দরকার।
মহামারি, নগরায়ণ ও কর্মজীবী নারীর হার বেড়ে যাওয়ায় চ্যালেঞ্জ আরো বাড়ল
ডা. সুপ্তা চৌধুরী
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ২ নম্বর অভীষ্টে উল্লিখিত শিশুসম্পর্কিত সূচকগুলোতে আমাদের সফলতা যেমন রয়েছে, তেমনি বেশ কিছু জায়গায় আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। খর্বকায় শিশুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আমরা সফলতা দেখিয়েছি। ২০১১ সালে এই হার ৪১ শতাংশ থাকলেও ২০২২ সালে এটি ২৪ শতাংশে নেমে আসে। বয়সের তুলনায় ওজন কম এমন শিশুর হার ৩৬ শতাংশ থেকে কমে ৩২ শতাংশ হয়েছে। এখানেও সফলতা দেখিয়েছি। কিন্তু কৃশকায় শিশুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আমরা গত কয়েক বছরে পিছিয়ে পড়েছি। ২০১১ সালে এই হার ছিল ১৬ শতাংশ। ২০১৭ সালে আমরা তা কমিয়ে ৮ শতাংশে নিয়ে এলেও ২০২২ সালে আবারও তা বেড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। করোনা মহামারি, দ্রুত নগরায়ণ ও কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিংয়ে আমরা পিছিয়ে পড়েছি বলে ধারণা করা যায়। আমাদের জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শসেবা প্রদানের দক্ষতা বাড়াতে হবে, মাতৃদুগ্ধ বিকল্প ও শিশুখাদ্য আইন বাস্তবায়ন করতে হবে এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা জোরদার করতে হবে। এই কাজগুলো করার জন্য সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা, সুধীসমাজসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষিত স্বামীর স্ত্রীর সিজারিয়ান হওয়ার হার বেশি
ডা. শেখ শাহেদ রহমান
গত ১০ বছরে বাংলাদেশে অনিয়ন্ত্রিত সিজারিয়ান সেকশনের মাত্রা বেড়েছে। ২০১৪ সালে এটি ছিল ১৮ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৩৫ শতাংশ, আর ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিত স্বামীর স্ত্রীর সিজারিয়ান হওয়ার হার বেশি। অন্যদিকে গুঁড়া দুধের প্রচারণা অনেক শক্তিশালী। সৌভাগ্যের বিষয়, আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিগত দু-তিন বছরে কখনোই কোনো গুঁড়া দুধের কম্পানির প্রগ্রামে যাননি। অর্থাৎ সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টা আছে সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য। পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য একটি পরিবেশ দরকার। আমাদের তথ্য-উপাত্ত বলছে, মা যদি শিক্ষিত হন তাহলে বুকের দুধ খাওয়ানোর হার একটু বাড়ে। আর যদি বাবা শিক্ষিত হন সে ক্ষেত্রে সিজারিয়ান বাড়ে। প্রকারান্তরে ঝুঁকি বাড়ে ও গুঁড়া দুধ খাওয়ানোর প্রবণতা বাড়ে।
বিশ্ব পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে ভাবছে, আমরা মাতৃত্বকালীন ছুটিই নিশ্চিত করতে পারছি না
নীলিমা আজাদ
সবচেয়ে বড় বাধা আমাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি মাত্র চার মাস। মাত্র ২৮ শতাংশ মা এই চার মাসের ছুটির পুরোটা পান। কিছু কারখানা এই ছুটি দিচ্ছে, কিছু কারখানা দিচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে কাজ ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তাঁদের কিভাবে আমরা ধরে রাখতে পারি এবং তাঁদের ছুটি আমরা নিশ্চিত করতে পারি, সেটি আমাদের ভাবতে হবে। গার্মেন্টসে মা যেন এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং চালিয়ে যেতে পারেন তার জন্য আমরা ডে কেয়ার সেন্টারের কথা বলি। বিশ্ব যেখানে পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে ভাবছে আমরা সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটিই নিশ্চিত করতে পারছি না। আমরা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলছি, কিন্তু সেটি করতে গিয়ে আমরা মাকে সন্তান থেকে দূরে সরিয়ে ফেলছি।
মায়ের অনুপস্থিতিতেও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব
ফারিয়া শবনম
মাতৃদুগ্ধ বিকল্প ও শিশুখাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইনটি কাগজে-কলমে অনেক ভালো একটি আইন। তবে মাঠ পর্যায়ে তদারকি ও বাস্তবায়ন অনেক পিছিয়ে। আইন না মানলে কী শাস্তি হবে সেটি কিন্তু অনেকেই জানে না। শাস্তি বাস্তবায়িতও হয় না, কারণ এর লোকবলও নেই।
সবাই বলছে, নগরায়ণ একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে আছে মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং কর্মক্ষেত্রে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য পরিবেশ তৈরি না হওয়ার বিষয়টি। আমি আরেকটি বিষয় লক্ষ করেছি, শহরে বা গ্রামে যেসব মা বাসায় থাকেন, তাঁরা নানা প্রয়োজনে এদিক-ওদিক যেতে পারেন। কিন্তু তাঁদের অনুপস্থিতিতে বা অবর্তমানে শিশুদের যে বুকের দুধ সংরক্ষণ করে খাওয়ানোর সুযোগ আছে এবং এ ক্ষেত্রে পরিবারের সবাই যে সহায়তা করতে পারে—এ বিষয়টিও আমরা ব্যাপক প্রচার করতে পারিনি। এ নিয়েও বর্তমানে কিছু কাজ করা হচ্ছে। কিভাবে গণমাধ্যমকে যুক্ত করে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
আমাদের কমপ্লিমেন্টারি ফিডিংয়ের অবস্থা ব্রেস্টফিডিংয়ের চেয়ে আরো খারাপ। বিডিএইচএসের তথ্য বলছে, বাচ্চাদের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য খাবারের পরিমাণ ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২৯ শতাংশে নেমে এসেছে। শিশুকে ন্যূনতম তিন বেলা খাবার দেওয়ার হার ৮১ শতাংশ থেকে নেমে ৬১ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে যেটা খেয়াল করার বিষয়, শিশুর বেভারেজ (চিনিযুক্ত পানীয় জাতীয় খাবার) খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ৩২ শতাংশ এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ বেড়েছে ৪৯ শতাংশ।
মানুষের জ্ঞান আছে, কিন্তু বাস্তব জীবনে প্রয়োগ নেই
ড. রুমানা আক্তার
আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, মায়ের দুধ খাওয়ানো সম্পর্কে ৯৫ শতাংশ লোকের জ্ঞান আছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে জ্ঞানের প্রয়োগ সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। শহরে-গ্রামে গরিব-ধনী সবাই জানে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো প্রয়োজন, কিন্তু গবেষণার (বিডিএইচএস ২০২২) ফলাফলে সেটার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। পুষ্টির বিভিন্ন সূচক, বিশেষ করে মায়ের দুধ, শিশুর বাড়তি খাবার বিষয়ে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। আমরা আরো দেখেছি, যেসব এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি চলমান আছে, পুষ্টির সূচকগুলো সেখানে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। আমাদের চিন্তা করে দেখতে হবে, যেখানে কোনো বিশেষ কর্মসূচি চলমান নেই, সেখানে আমরা কেন পিছিয়ে আছি। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পুষ্টিবিষয়ক কাউন্সেলিংয়ের ক্ষেত্রেও আমাদের অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। একজন গর্ভবতী মহিলা যখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে যাবেন, তখন পুষ্টিবিষয়ক কাউন্সেলিংগুলো তাঁকে সময় নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে করতে হবে, যেন তিনি বাস্তব জীবনে তার যথাযথ প্রয়োগ করেন। শিশুর সর্বোত্তম বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রাণীজ জাতীয় খাবার খাওয়ানোর দিকেও আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্যের আইনের প্রয়োগ বিষয়টি আরো গুরুত্ব দিতে হবে।
সবার আগে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে
মুহাম্মদ ইমরানুল হক
গ্রামের প্রান্তিক এবং শহরের ভাসমান মানুষেরা প্রায় সময়ই বিভিন্ন স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রমের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। সমস্যার শুরুটা হয় তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে না পারা। এই জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে মাতৃদুগ্ধ পানসংশ্লিষ্ট বার্তা পৌঁছাতে হবে। এই ধরনের এলাকা এবং মানুষের কথা মাথায় রেখে আলাদাভাবে কার্যক্রম পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে উল্লেখ থাকে যে সব মানুষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসে না, না আসা জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিংয়ে বাধা অপ্রতুল মাতৃত্বকালীন ছুটি ও কর্মক্ষেত্রে ডে কেয়ার সেন্টার না থাকা
মিথুন গুপ্ত
আমাদের কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা বেড়েছে। পোশাকশিল্প কারখানায় (গার্মেন্টস সেক্টর) যেসব মা কাজ করেন, তাঁদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয় চার মাস বা ১২০ দিন। প্রসবের আগে দুই মাস আর প্রসবের পরে দুই মাস। এই দুই মাসের মধ্যে তিনি কিভাবে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করাবেন? আমরা যতই তাঁদের বলি না কেন এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং বাচ্চাদের জন্য জরুরি, কিন্তু তাঁদের জন্য তো সেই পরিবেশ তৈরি করা হয়নি।
আর যাঁরা অন্যান্য চাকরি বা খাতে আছেন, তাঁদের ছুটি থাকে ছয় মাস। তাঁরাও কিন্তু যথাযথভাবে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করাতে পারছেন না। কারণ সেই সময়টা পুরোপুরি পাওয়া যায় না। প্রসবের দুই মাস আগেই স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যেতে হয়।
দ্রুত নগরায়ণের সময়ে শহুরে প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ
জ্যোতিরাজ পাত্র
কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড অনেক ক্ষেত্রে কাজ করেছে। আমাদের দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন শহরে আসছে। এদের অনেকেই বস্তি ও অনুন্নত এলাকায় থাকে। এই শ্রেণিকে নিয়ে আমরা কিভাবে কাজ করব? দ্রুত নগরায়ণের এই সময়ে শহুরে প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা একটা চ্যালেঞ্জ, একই সঙ্গে সুযোগও বটে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অংশীদারি। পুষ্টি ও মাতৃদুগ্ধ পান করানোর বিষয়ে বিভিন্ন সেক্টরের অংশীদারি প্রয়োজন। এখানে অনেক আন্তর্জাতিক এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী, গণমাধ্যমসহ অনেকেই আছে। গণমাধ্যমের ভূমিকা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি বেশি গুরুত্ব দিতে চাই বেসরকারি খাতের ভূমিকাকে।
মানুষ তৈরি না হলে দেশ তৈরি হবে না
ইমদাদুল হক মিলন
স্বাস্থ্যবান জাতি অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য স্বাস্থ্যবান মানুষ দরকার। মানুষ তৈরি না হলে দেশ তৈরি হবে না। আমরা যে যার জায়গা থেকে যদি চেষ্টা করি, তাহলে আজকের আলোচনায় আসা প্রতিটি সমস্যাই জয় করা সম্ভব।
আজকের আলোচনায় গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা এসেছে নানাভাবে। আমি বলব, গণমাধ্যম তার ভূমিকা পালন করছে। গণমাধ্যম চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছু দেখিয়ে দেয় বলে এখন সমাজ ও রাষ্ট্র খুব ভালোভাবে চলছে। আমাদের ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের তিনটি দৈনিক পত্রিকা, দুটি টেলিভিশন চ্যানেল, একটি অনলাইন পোর্টাল ও একটি রেডিও রয়েছে। শুধু আমরাই যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরির কাজ করি, তাহলে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
সুপারিশ
► জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে শালদুধ, ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ, ছয় মাসের পর থেকে দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি বাড়তি খাবার খাওয়াতে হবে।
► শিশুর ব্রেইন সেল তৈরি করতে গেলে মাকে সুষম পুষ্টি দিতে হবে এবং মাকে মানসিক প্রশান্তির মধ্যে রাখতে হবে।
► এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের কাউন্সেলিং স্কিল বাড়ানোসহ গণমাধ্যমের ভূমিকা জোরদার করতে হবে। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সুধীসমাজসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
► মাতৃদুগ্ধের বিকল্প ও শিশুখাদ্য আইন সম্পর্কে সবাইকে অবহিত ও সচেতন করতে হবে এবং আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।
► প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ওপর জোর দিতে হবে এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার কমাতে হবে।
► কমিউনিটি ক্লিনিক ও হাসপাতালের ধারণক্ষমতা, চিকিৎসকসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী আরো বাড়াতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে আরো সক্রিয় করতে হবে।
► কিশোরী পুষ্টিসেবা ও গর্ভবতী মায়ের পুষ্টির দিকে নজর দিতে হবে।
► মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্যের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
► কর্মক্ষেত্রে ডে কেয়ার সেন্টার ও বুকের দুধ পান করানোর নির্দিষ্ট স্থান রাখতে হবে।
► পর্যাপ্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করতে হবে।
► মাঠ পর্যায়ে কর্মজীবী মায়েদের সঠিক পরিবেশ ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।
► গ্রামে গ্রামে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বুকের দুধ ও পুষ্টির গুরুত্ব শেখাতে ও বোঝাতে হবে।
► শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য স্বামী এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সমর্থন প্রয়োজন।