অর্থভুবন প্রতিবেদক
দূরের পথ কম সময়ে পাড়ি দেওয়ার জন্য উড়োজাহাজের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এই উড়োজাহাজকে যদি কেউ বাড়ি-ঘর বানিয়ে ফেলেন, মানে এর মধ্যে বসাবাস শুরু করেন, তবে? শুনতে আশ্চর্যজনক হলেও এমন মানুষ সত্যিই আছেন, যাঁরা পরিত্যক্ত উড়োজাহাজে বসবাস করছেন কিংবা করেছেন।
অথচ মিসিসিপির বেনোয়েটের রুপচর্চাকর্মী আসারির উড়োজাহাজের সঙ্গে পেশাগত কোনো সংযোগই ছিল না। প্রথমে তাঁর দেবরের, যিনি কিনা ছিলেন একজন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার, পরামর্শ অনুসরণ করেছিলেন। তিনি ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত উড়োজাহাজটিতে বাস করেন। পরে জনসাধারণের সামনে প্রদর্শনের জন্য অন্য একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাক থেকে পড়ে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হয় তাঁর এই আশ্চর্য বাসস্থানের।
অবশ্য তিনি উড়োজাহাজে বসবাসকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন না। এদিকে তাঁর এভাবে উড়োজাহাজবাড়িতে থাকার বিষয়টি অন্যদের অনুপ্রেরণাও জোগায়। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্সধারী বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী ব্রুস ক্যাম্পবেল, তাঁর গল্প শুনে উৎসাহী হন। ‘আমি গাড়িতে চেপে বাড়ি ফেরার সময় রেডিও শুনছিলাম। তখন সেখানে জো অ্যানের গল্পটা বলা হয়। এটা এতটাই বিস্ময়কর ছিল এবং আমার মনোযোগ কেড়ে নেয় যে, গাড়ি চালাতে পারছিলাম না। পরদিন সকালে আমি ফোন করি তাঁকে।’ বলেন তিনি।
ক্যাম্পবেল যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগনের হিলসবোরোর জঙ্গলে পরিত্যাক্ত বোয়িং ৭২৭ উড়োজাহাজটিতে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাস করছেন। আর এর জন্য জো অ্যানের প্রতি কৃতজ্ঞ বলে জানান তিনি। তাঁর এই পরিত্যাক্ত উড়োজাহাজ কেনা এবং একে বাড়িতে রূপান্তরে মোটমাট খরচ হয় ২ লাখ ২০ হাজার ডলার। গ্রিসের অলিম্পিক এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজ ছিল সেটি আগে। বেশ পুরোনো ধাঁচের হওয়ায় বাড়ি হিসেবে এটা ততটা উপযোগী ছিল না বলে জানান ক্যাম্পবেল।
এর জন্য ক্যাম্পবেলকে এটিতে বসবাস করার আগে কয়েক বছর ধরে একে নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। তবে প্রবল শীতের সময় এখানে থাকাটা কঠিন বলে ওই সময়টা জাপানের মিয়াজাকির নিজের ছোট্ট অ্যাপার্টম্যান্টটায় থাকতেন। তবে মহামারির সময় পরিস্থিতটা একটু কঠিন হয় পড়ায় বছরভর ৭২৭ উড়োজাহাজটিতে থাকতে শুরু করেন।
ক্যাম্পবেল প্রায়ই দর্শনার্থীদের এমনকি বিনা মূল্যে তাঁর উড়োজাহাজবাড়িতে থাকারও সুযোগ করে দেন। গ্রীষ্মে নাচ-গানের নানা আয়োজনও হয় এখানে।
একটা উড়োজাহাজে মানুষ থাকে খবরটাই যদি আপনার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়, তখন দুটি উড়োজাহাজে কেউ বাস করেন শুনলে কেমন লাগবে? আর এমনই পরিকল্পনা জো এক্সলাইনের। তাঁর দুটি পরিত্যাক্ত উড়োজাহাজ আছে। একটি এমডি-৮০, অপরটি ডিসি-৯। টেক্সাসের ব্রুকশায়ারে নিজের জায়গায় এগুলো স্থাপন করেছেন। ২০১১ সালের এপ্রিলের ১ তারিখ স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে গত এক যুগ ধরে মিড-৮০ উড়োজাহাজটিকে বাড়িতে রূপান্তর করে এতে বসবাস করছেন তিনি। এখন ডিসি-৮ উড়োজাহাজটি সংস্কার করে মুভি থিয়েটার ও মিউজিক রুমে রূপান্তরের কথা ভাবছেন।
কয়েক বছর এমনকি ক্যাম্পবেলের সন্তানেরাও উড়োজাহটিতে থেকেছেন। ‘বাচ্চারা এখন চলে গেছে, তাই এখানে কেবল আমিই থাকি।’ বলেন তিনি, ‘আমার মাস্টার বেডরুম ১০ ফুট বাই ১৮ ফুট। শোওয়ার ঘর হিসেবে নেহাত খারাপ নয়। এখানে দুটি টিভি বসিয়েছি, চারপাশে হাঁটার জন্য প্রচুর জায়গা আছে। আমার বসার ঘরটির আকারও ভালো। ডাইনিং রুমে চারটি বসার আসন আছে। অনেক মানুষ বেড়াতে এলেও রান্নাঘরে পর্যাপ্ত খাবার রান্না করতে পারি। আমার একটি শাওয়ার আর একটি টয়লেটও আছে। তাই আমাকে বিশ্রামাগারে যাওয়ার জন্য উড়োজাহাজ থেকে বের হতে হয় না। একটা জিনিসই আমার কাছে নেই, তা হলো খোলা জানালা।’ তিনি জানান, কেবল তাজা বাতাস ভেতরে প্রবেশ করাতে বিমানের দরজা খোলেন।
উড়োজাহাজকে বাড়িতে রূপান্তরে আরও কিছু বিখ্যাত উদাহরণও আছে। যেমন একটি বোয়িং ৩০৭ স্ট্রেটোলাইনারকে বিপুল অর্থ খরচ করে ধনকুবের এবং চিত্রপরিচালক হাওয়ার্ড হিউজ একটি ‘উড়ন্ত পেন্টহাউসে’ পরিণত করেছিলেন। একটি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আরেক কাণ্ড করেন। বিপুল পরিবর্তন এনে একে একটি মোটরইয়ট বা ছোটখাটো প্রমোদতরিতে রূপান্তর করেন। ১৯৮০-র দশকে ফ্লোরিডার বাসিন্দা ডেভ ড্রিমার এটা কিনে ব্যাপকভাবে সংস্কার করেন এবং নাম দেন ‘কসমিক মাফিন’। তিনি ২০ বছর উড়োজাহাজ-জাহাজের এই হাইব্রিড বা সংকরে বাস করেন। পরে ২০১৮ সালে ফ্লোরিডা এয়ার মিউজিয়ামে দান করেন এটি।
মার্কিন কান্ট্রি সিঙ্গার রেড লেন, যিনি একসময় উড়োজাহাজের মেকানিক ছিলেন, কয়েক দশক একটি ডিসি-৮ উড়োজাহাজে থাকেন। ২০১৫ সালে মারা যাওয়া এই শিল্পী ২০০৬ সালের এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কখনো আমার এখানে ঘুম ভেঙে মনে হয়নি অন্য কোথাও থাকলে ভালো হতো।’
কেউ যদি এ ধরনের উড়োজাহাজ বাড়িতে একটি কি দুটি রাত কাটাতে চান, তাঁদের জন্য উড়োজাহাজ-হোটেলের মাধ্যমে সেই শখ মেটানোর সুযোগ আছে। যেমন কোস্টারিকার কোস্টা ভার্দে হোটেলে আপনি বোয়িং ৭২৭-এ থাকার সুযোগ পাবেন। মজার ঘটনা হলো, এটা জঙ্গলের মধ্যে। আর এখান থেকে সাগরও দেখতে পারবেন। একইভাবে সুইডেনের জাম্বো স্টে হলো বায়িং ৭৪৭-এর মধ্যে তৈরি একটি হোটেল। আবার শুধু পার্টির জন্য একটি উড়োজাহাজ পেতে চাইলে যেতে পারেন ইংল্যান্ডের লন্ডনের ১০০ মাইল পশ্চিমে কস্টওয়ল্ড এয়ারপোর্টে। সেখানে ২২০ জন মানুষ ধারণক্ষমতার একটি বোয়িং ৭৪৭ উড়োজাহাজকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।