ড. আর এম দেবনাথ
সরকারের অনুসৃত নীতি হচ্ছে বাজার অর্থনীতি (মার্কেট ইকোনমি)। কিন্তু মনে হচ্ছে, অনেক মাননীয় মন্ত্রীর নীতি সরকারি নীতির ঠিক বিপরীত! এ কথা বলার সাহস কীভাবে পেলাম? পেলাম অন্তত দুজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর অনুসৃত নীতি দেখে বা পর্যবেক্ষণ করে। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, অন্যজন হলেন মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। প্রথমজন ব্যাংক আমানতের টানাটানি দেখেও তা বৃদ্ধির জন্য সুদের হার বাড়াতে চান না। অথচ বাজার অর্থনীতি বলে, তা করা উচিত। ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার কত হওয়া উচিত? তা মূল্যস্ফীতির যে হার, তার অন্তত সমান হওয়া উচিত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয় তা চায় না। এদিকে বিশিষ্ট শিল্পপতি আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বাজার অর্থনীতির কারণে লাভবান একজন ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও তিনি চাল, আলু, পেঁয়াজ, ডিম ইত্যাদির ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতি প্রয়োগ করতে চান না। চাল বাদে এ মুহূর্তে পেঁয়াজ, আলু, ডিম ইত্যাদি নিয়ে বাজারে তুলকালাম কাণ্ড ঘটছে। কিছুদিন আগে একই কাণ্ড ঘটেছে কাঁচামরিচ নিয়ে। জানা কথা, বাজারে চাহিদা-সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো না করলে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে। ‘বাজার’ বাজারের মতো চলে। সেখানে প্রশাসনিক পদক্ষেপ, দণ্ড, সভা-আলোচনা, এমনকি মূল্য নির্ধারণী ব্যবস্থা কোনো কাজে আসে না। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের বাজার। যুগান্তরের এক খবরে দেখা যাচ্ছে, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে ডিম বিক্রি হচ্ছিল না। সরকারি দাম হচ্ছে ডিমপ্রতি ১২ টাকা। বাজারে এ দামে ডিম বিক্রি হচ্ছিল না। এরপর ডিম আমদানির সিদ্ধান্তের পর দাম ১২ টাকায় নেমে আসে।
বাজারের এ পরিস্থিতির জন্য নানা কারণের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। কেউ বলছেন, এটা ‘সিন্ডিকেটের’ কারসাজি, অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজি। কেউ বলছেন, চাহিদা ও সরবরাহ হিসাবের গরমিল। কেউ বলছেন উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কথা। এসব ‘কারণের’ কথা শুনতে শুনতে মানুষ পাগলপ্রায়। ডিম খাওয়ার কোনো জো নেই। মাছের বাজার চড়া। মাছের বিকল্প হিসাবে মানুষ ডিমের দিকে ঝুঁকেছে। এখন বলা হচ্ছে, মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটি। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? মাছ ছাড়ল মানুষ উচ্চমূল্যের জন্য, এখন ডিমও ছাড়তে হচ্ছে উচ্চমূল্যের জন্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ডিমের দাম, পেঁয়াজের দাম, আলুর দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। শুধু এবার নয়, এর আগেও অনেক পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য, বাজার এসব কথা শোনে না। বাজার প্রশাসন বোঝে না, সরকার বোঝে না, সভা-সমিতি-আলোচনা বোঝে না। বাজার বোঝে বাজারের কথা। যেমন বোঝে এমনকি গরিব রিকশাওয়ালা ভাইয়েরাও। বৃষ্টি, রোদ, অফিসের সময়, স্কুলের সময় তারা বেশি ভাড়া দাবি করে। তারাও বোঝে চাহিদা বেশি। এমনকি রিকশার সংখ্যা অনেক বেশি হলেও কেউ দাম কমায় না। রিকশাওয়ালারা যা করে, আমাদের ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ী ভাইয়েরাও তা-ই করে। কোনো ছাড় নেই। সুযোগ পেলেই, ন্যূনতম কারণ পেলেই, অজুহাত পেলেই তারা বাজার চড়া করে। এ অবস্থা দেখে আসছি স্বাধীনতার পর থেকেই। স্বাধীনতার পরপরই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এর ফল হিসাবে অভ্যন্তরীণ বাজারেও সব জিনিসের দাম বাড়ে। বাজারে, হাটে-ঘাটে তুমুল উত্তেজনা। এমনকি একসময় রিকশাভাড়া পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। শুধু এ ঘটনা নয়, গত দীর্ঘ ৫১-৫২ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, দাম নির্ধারণে কোনো কাজ হয় না। প্রশাসনিক ব্যবস্থা, জেল-জরিমানায়ও কোনো কাজ হয় না। কাজ হয় বরং সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করলে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত।
মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ এ জন্য যে, তিনি দেরিতে হলেও ‘বাজারের’ নিয়মনীতি অনুসরণে উদ্যোগী হয়েছেন। ডিমের বাজার চড়ছে। তিনি অনেক চেষ্টা করেও ডিমের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাই ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১০ কোটি ডিম আমদানি হবে। মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না দাম ন্যায্য ও স্থিতিশীল হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ডিম আমদানি চলতে থাকবে। খবরে দেখা যাচ্ছে, এ সিদ্ধান্তের পরই বাজারে এর অনুকূল প্রভাব পড়েছে। দেখা যাক ডিম বিদেশ থেকে আনার পর কী হয়। কী হয় সেটা পরের ঘটনা, ইতোমধ্যে ডিমের উৎপাদক, সরবরাহকারী, বিক্রেতারা যা মুনাফা লোটার তা লুটে ফেলেছেন। এটাই বাজার অর্থনীতির ফল। ভোক্তার স্বার্থের বিপরীতে ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা অর্জন।
এসবের শেষ কোথায়? শেষ আছে কিনা জানি না, তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি, সরকারের হাতে ‘সমান্তরাল বণ্টন’ ব্যবস্থা থাকা দরকার। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে, নরম-গরম কথা বলে, ব্যবসায়ীদের অনুরোধ-উপরোধ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বাজার বিশাল। হাজার হাজার বিক্রেতা, উৎপাদক, সরবরাহকারী, স্তরে স্তরে মধ্যস্বত্বভোগী। তারা সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাদের লক্ষ্য মুনাফা করা, অতিমুনাফা করা, ধনী হওয়া। এখানে দেশপ্রেমের বাণী, বিচার-আচারের হুমকি কোনো কাজে অতীতে আসেনি, এখনো আসছে না, আগামী দিনেও আসবে না। করণীয় হচ্ছে, ‘স্থায়ী বণ্টন ব্যবস্থা’ (মার্কেটিং চ্যানেল) গড়ে তোলা। এক সময়ে দেশে রেশনিং ব্যবস্থা ছিল। যাদের রেশন কার্ড ছিল, তারা নির্ধারিত দোকান থেকে নির্ধারিত দামে প্রতি সপ্তাহে পণ্য তুলতে পারত। জানা যায়, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রেশনিং ব্যবস্থা আছে। সেখানে দুই ধরনের কার্ড। সেই অনুপাতে কে কত জিনিস কত দামে পাবে তা ঠিক হয়। এ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। জানি না কী কারণে হঠাৎ আমাদের দেশ থেকে রেশনিং ব্যবস্থা তুলে দিয়ে বাজার অর্থনীতির আশ্রয় নেওয়া হলো। বাজার অর্থনীতি নয়, উগ্র বাজার অর্থনীতির। কিন্তু কারও মাথায় ঢুকল না যে, বাজার অর্থনীতির ‘বাজার’ ঠিক রাখার জন্যই ‘সমান্তরাল বিপণন ব্যবস্থা’ দরকার, যাতে বাজারের অত্যাচারে সাধারণ ভোক্তারা নির্যাতিত না হন। রেশনিং বা স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটা পদক্ষেপ। আমরা যা করেছি তা হচ্ছে, রেশনিং তুলে দিয়ে টিসিবির মাধ্যমে সময় সময় পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা। এর জন্য কার্ডও প্রবর্তন করা হচ্ছে। অন্যান্য খোলাবাজারি ব্যবস্থাও চালু হয়েছে, সময় সময় হচ্ছে। দৃশ্যত এসব হলো ‘এডহক’ ব্যবস্থা, কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। অথচ অভিজ্ঞতা বলছে, বাজার অর্থনীতির অধীনে ব্যবসায়ীদের চলমান স্বৈরাচার থেকে মুক্তির জন্য দরকার একটা স্থায়ী ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা দরকার। যারা রেশনিং ব্যবস্থা তুলে দিয়েছিলেন, তারা এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল।
এ প্রসঙ্গে ১৯৭৫ সালের দিকে গৃহীত একটা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়। তখনো ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সংস্থাটি ছিল। এর কাজ ছিল বৃহৎ পরিমাণে পণ্য আমদানি করা, বণ্টন করা নয়। সংগ্রহ করা এবং বণ্টন করার কাজ দুটি তখন আলাদা করা হয়। বঙ্গবন্ধু সমবায়ের অধীনে কনজিউমার সাপ্লাইজ করপোরেশন (কসকর) বলে একটি সংস্থা তৈরি করেছিলেন। এর কাজ ছিল পণ্য, জিনিসপত্র বণ্টন করা। পণ্য আমদানি/সংগ্রহের কাজ তাদের ছিল না। তারা শুধু বণ্টন করত। সারা দেশে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে কসকরের দোকান (আউটলেট) খোলা হয়েছিল। বেশ কাজে দিচ্ছিল সংস্থাটি। খোলাবাজারে উচ্চমূল্যের প্রেক্ষাপটে এ সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করা হয় বিকল্প বিপণন ব্যবস্থা হিসাবে। পদক্ষেপটি ছিল যুগোপযোগী। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বঙ্গবন্ধু শহিদ হওয়ার পর ওই সংস্থাটি ধীরে ধীরে তুলে দেওয়া হয়। বাজার অর্থনীতির নামে গ্রাহক-ভোক্তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় আগ্রাসী ব্যবসায়ীদের হাতে। এর ফলে আমরা এখন ভুগছি।
আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে, একটি স্থায়ী বিকল্প বিপণন ব্যবস্থা দরকার। আমরা এদিকে নজর না দিয়ে অস্থায়ী/এডহক ব্যবস্থা দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। এতে ফলোদয় হবে বলে আমি মনে করি না। আমরা যতই ‘সিন্ডিকেট’, ‘বিগ বিজনেস’, ‘মনোপলি’, একচেটিয়া কারবারের ওপর দোষ চাপিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি না কেন, তাতে ফল মিলবে না। এটা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। আমরা ‘একশ্রেণির ব্যবসায়ী’, ‘অসৎ ব্যবসায়ীদের’ ওপর দোষ চাপাচ্ছি। অথচ কেউ আমরা জানি না কারা এই ‘একশ্রেণির ব্যবসায়ী’, কারা ‘অসৎ ব্যবসায়ী’। এই শ্রেণিতে কে পড়ে, কে পড়ে না, তা কে ঠিক করবে? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। অতএব, অভিজ্ঞতার আলোকে ভোগ্যপণ্যের বাজারে স্থায়ী স্থিতিশীলতা, স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে এবং তা বজায় রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারকে বলব। শুধু ভোগ্যপণ্য বলি কেন, অন্যান্য সেবা ও পণ্যের ক্ষেত্রেও তা করা যেতে পারে। বাজার অর্থনীতির নামে বিমানের টিকিটের মূল্য আজ এক, কাল আরেক; সকালে এক, বিকালে আরেক হওয়া উচিত কি? এতে টেকসই ব্যবস্থা গড়া যায় না। মানুষ ভোগে এক অবিরাম অনিশ্চয়তায়, অস্থিতিশীলতায়। অথচ তাদের দরকার একটু শান্তি ও স্বস্তি।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়