অর্থভুবন প্রতিবেদক
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বতন্ত্র সমাজতান্ত্রিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে শোষণ-বঞ্চনাহীন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্বনির্ভর সোনার বাংলা গঠন করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র অন্যান্য দেশের সমাজতন্ত্র থেকে পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। সমাজতন্ত্রকে তিনি কোনো তাত্ত্বিক ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি, বরং তিনি চেয়েছিলেন একটি অর্থনৈতিক দর্শন, যেটি সামাজিক বাস্তবতা ও পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি সমাজব্যবস্থা, যাতে কৃষকের কল্যাণ হবে, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুযোগের সমতা থাকবে, যেখানে জমিদারি ও সামন্তীয় শোষণ প্রথার অস্তিত্ব থাকবে না এবং গরিব মেহনতি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।
শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক দর্শনের মূল উপজীব্য হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন মানে হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া, বিশেষ করে যারা ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যারা বরাবর উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত থাকে। কিন্তু এর প্রাথমিক শর্ত হলো অর্থনৈতিক রূপান্তর। এই রূপান্তরের অনেকগুলো উপাদান রয়েছে।
শেখ হাসিনা গত দেড় দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের নিকৃষ্ট সূচকগুলো পুরোপুরি উল্টে দিয়েছেন। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এসডিজিতে বলা হয়েছে, ‘কাউকে পেছনে রেখে নয়’।
১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখনই শেখ হাসিনা তাঁর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বাস্তবায়নে হাত দেন। তাঁর হাত ধরেই যমুনা বহুমুখী সেতু বা বঙ্গবন্ধু সেতু বাস্তবায়িত হয়। এর ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সে সময়ে তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি বেসরকারীকরণ ও রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে তোলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ব্যক্তি খাতে টেলিভিশন, মুঠোফোন ও বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি করেন, সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে তিনি আরো বিস্তৃত পরিসরে সম্প্রসারণ করেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করার পর তিনি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় হাত দেন। রূপকল্প ২০২১ গ্রহণ করে তার আলোকে ১১ বছর মেয়াদি প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় (২০১০-২০২১)। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ কী অর্জন করতে চায়, তা দুটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিকল্পনাজগতে ‘প্যারাডাইম শিফট’ হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে মধ্যম আয় ও ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করার রূপরেখা তৈরি হয়। এই পরিকল্পনার মূল বৈশিষ্ট্য হলো পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে বাজেট ও পরিকল্পনার সামষ্টিক অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে সংযুক্ত করা।
বাংলাদেশের প্রথম রূপকল্প দলিল ২০২১ ও তার ভিত্তিতে প্রণীত ষষ্ঠ (২০১১-২০১৫) ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) প্রণয়নকালে আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থাগুলোর কোনো দিকনির্দেশনাভিত্তিক দলিল; যেমন—ওয়াশিংটন কনসেনসাস (১৯৮৯) কিংবা পিআরএসপি (২০০৩-২০০৯) বিবেচনায় ছিল না। তাই এসব পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ দেশজ বাস্তবতা ও জনচাহিদায় প্রণীত, যে কারণে এসব দিয়েই বাংলাদেশে নতুন জাতীয় পরিকল্পনার যুগ শুরু হয়। এই ‘নয়া জাতীয় পরিকল্পনা যুগের’ বৈশিষ্ট্য হলো দেশজ বাস্তবতা, জাতীয় সত্তাতাড়িত, জাতীয় নেতৃত্বের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রণীত। এই নয়া জাতীয় পরিকল্পনার ফলেই বাংলাদেশ নয়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুগে প্রবেশ করে। এর ফলে গত দেড় দশকে প্রবৃদ্ধির বিরামহীন দ্রুত উল্লম্ফন ঘটে। প্রবৃদ্ধির বিচারে গত দশকে বাংলাদেশের চেয়ে একমাত্র চীনই এগিয়ে ছিল।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য তিনি প্রথমে মেগাপ্রকল্পে হাত দেন। তাঁর নির্দেশনায় দেশে হাতিরঝিল, কুড়িল ফ্লাইওভার, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদিসহ ডজনের ওপর মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন দেশকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য পরিবর্তন করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই। অবকাঠামো উন্নয়ন হলেই বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে। ২০০৯ সালের আগে দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল। অথচ মাত্র এক দশকে দেশের মানুষ প্রায় ১০০ শতাংশ বিদ্যুতের সুবিধা পেয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, বৈদ্যুতিকায়ন এবং এর ফল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। পার্বত্য এলাকা ও হাওর এলাকার কিছু অংশ বাদে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে এখন সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং তা দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রেখেছে। শহর-গ্রাম পার্থক্য কমে গেছে। গত দশকে বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগ বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এর মূলে ছিল ডজনের বেশি মেগাপ্রকল্প গ্রহণ এবং অর্ধশতকের বেশি অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ফলে বিনিয়োগ বিকাশের এক অপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য কমে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সমার্থক বাংলাদেশের একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান টাইগার হিসেবে উত্থান ঘটে।
শেখ হাসিনার উদ্যোগে গৃহীত আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গ্রামের দরিদ্র মানুষের ভাগ্যবদলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব পুঁজি গঠন ও বিনিয়োগে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীবিকার মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ছিন্নমূল ও গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জীবনে এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের ১৩ লাখ গৃহহীন পরিবার এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছে। তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে জনগণের দোরগোড়ায় এখন সরকারি সেবা পৌঁছে গেছে। দেশে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপিত হয়েছে, যার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ দূর থেকেই সরকারি সেবা গ্রহণ করতে পারছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাসহ নারীর প্রজনন, পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃস্বাস্থ্য, মা ও শিশুর পুষ্টি বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। বিনা মূল্যে ২৭ রকমের ওষুধ পাচ্ছে প্রান্তিক জনগণ।
শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক দর্শনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানবসম্পদের উন্নয়ন ও বিকাশ। এ লক্ষ্যে ব্যাপক শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ও বিনা মূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি শিক্ষাক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রাথমিকের ক্ষেত্রে ভর্তির হার এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে সামাজিক পুঁজির উদ্ভব ঘটে তার মূল কারণ সরকারের দূরদর্শী নীতি। এর ফলে দলভিত্তিক ও ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার ২০০৬ সালের ২৯ শতাংশ এবং ২০১৭ সালের জরিপের ৩৬.৩ শতাংশ থেকে এখন ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অথচ ভারতে এই হার মাত্র ২০ শতাংশ, পাকিস্তানে তা ২০ শতাংশ। নারীর এই অপূর্ব ক্ষমতায়ন ঘটেছে শেখ হাসিনার হাত ধরেই।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিগত দশকে বাংলাদেশে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকার এখন কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছে। সারা দেশে ব্যাপক শিক্ষা অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সরকার এখন জনগণের দোরগোড়ায় সেবা দিতে বদ্ধপরিকর। ডিজিটাল আউটসোর্সিং সেবা প্রদানে সারা দেশে এখন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ তরুণ জড়িত রয়েছে, তাদের বার্ষিক আয় প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।
শেখ হাসিনার উদ্যোগের ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ গ্রামে শহরের সুবিধাদি নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান কমিয়ে আনা হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো আরো সমন্বিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে জীবনচক্রভিত্তিক কাঠামোর আওতায় আনতে সরকার ২০১৫ সালে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র গ্রহণ করে। এর উদ্দেশ্য হলো প্রচলিত কর্মসূচিগুলো আরো কার্যকর ও ফলপ্রসূ করে তোলা এবং স্বেচ্ছামূলক সবার জন্য পেনশন স্কিম চালু করা। এরই মধ্যে এই স্কিম ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ পর্যন্ত ১০ কোটি প্রান্তিক ও নিম্নবিত্ত মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সহায়তা পেয়েছে।
শেখ হাসিনার উন্নয়ন মডেলের বড় শক্তি হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ভারত সরকারের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির মডেল হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নের মতো তৃণমূল পর্যায়ের মানব উন্নয়ন দ্বারা উদ্বুদ্ধ।’ শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন দর্শন দেশকে অভূতপূর্বভাবে এগিয়ে নিচ্ছে।
লেখক : সামষ্টিক পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়