অর্থভুবন প্রতিবেদক
দেশি-বিদেশি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনা-বেচার প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্দেশনা অমান্য করায় এসব ব্যাংককে শাস্তি দেওয়ার পদক্ষেপ শুরু করেছে আর্থিক খাতে শীর্ষ এই সংস্থা। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না জানতে চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক।
তিনি বলেন, তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই তালিকায় দেশি-বিদেশি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রয়েছে। এর আগে গত জুলাই মাসে ১৩টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ডলার দর নিয়ে কারসাজির অভিযোগ পেয়ে অধিকতর তদন্ত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই ১৩টি ব্যাংকের মধ্যে ১০টির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ডলারের দর বেশি রাখা হচ্ছে এমন অভিযোগের পরপরই তা রোধ করতে শক্ত অবস্থানে গিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গভর্নরের কড়া নির্দেশ পেয়েই কর্মকর্তারা তদন্তে নামছেন বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা।
একই অভিযোগে গত বছরের আগস্টে অতিরিক্ত দরে ডলার কেনা-বেচায় দেশি বিদেশি ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময়ে ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের নাম প্রকাশ হয়েছিল সংবাদ মাধ্যমে।
তাদের কাছ থেকে কৈফিয়ত চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাখ্যা পেয়ে আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে এক মাস পরে ট্রেজারি প্রধানদের পুনর্বহাল করার সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছিল, অতিরিক্ত দরে ডলার বিক্রি থেকে প্রাপ্ত মুনাফার অর্ধেক সিএসআর তহবিলে স্থানান্তর করার। আর পরবর্তী সময়ে আইনি সীমাবদ্ধতার সুযোগে যেন ডলারের দর বাড়ানো না হয়, ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এমন অঙ্গীকার নেওয়া হয়। পাশাপাশি ট্রেজারি প্রধানদের ডলার কারসাজিতে জড়িত থাকাকে ‘অনৈতিক চর্চা’ বলেও আখ্যা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের পরামর্শে ডলারের বিনিময় হার একাধিক দর থেকে একক দরে নামিয়ে আনতে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই পদক্ষেপ হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন-বাফেদা এবং ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন-এবিবি ডলারের দর নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু নির্ধারিত সেই দরও মানেনি ১০ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোন ব্যাংক কী পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা সংরক্ষণ করতে পারবে, তার একটি সীমা (এনওপি-নেট ওপেন পজিশন) নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আগে ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি মুদ্রা সংরক্ষণ করার সুযোগ ছিল। ডলার বাজারের অস্থিরতা কমাতে ২০২২ সালের ১৫ জুলাই তা কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এই সীমার বেশি ডলার হাতে থাকলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্য কোনো ব্যাংকের কাছে বিক্রি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে ব্যাংকগুলোর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলারের সরবরাহ সংকটে কিছু ব্যাংকও সীমার অতিরিক্ত মুদ্রা জমিয়ে রেখে অতিরিক্ত মুনাফা করে। সুযোগ থাকলেও তা বাজারে না ছেড়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দর বাড়ানো হয়। আবার কয়েকটি ব্যাংক ডলার সংরক্ষণের তথ্যও গোপন করে।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ির পরও বাফেদা ও এবিবি-এর নির্ধারণ করে দেওয়া দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনা-বেচা করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। গত সোমবার এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের কাছে অভিযোগ জানান যে, অনেক ব্যবসায়ীকে নির্ধারিত রেটের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হচ্ছে। গভর্নর অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।