Tuesday, January 14, 2025

সমস্যা না থাকলেও যেন সমস্যা সময়ের আলো

সিঙ্গল মাদার শুনলেই এখনও লোকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায়। সে দৃষ্টির ভাষা চট করে বুঝতে পারে একমাত্র সিঙ্গেল মাদাররাই। কেউ সাহসের সঙ্গে উত্তর দেয়। কেউ আবার উত্তর দিতে কুণ্ঠাবোধ করে। কারণ আমাদের সমাজে এখনও স্বামীর পরিচয়ে বাঁচাটাই অনেক বেশি সম্মানের। আমি এখনও শুনতে পাই বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, সংসারটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করিস মা। স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকদের আপন করে নিবি। তারা যা বলে মেনে চলার চেষ্টা করবি। সমস্যা হচ্ছে আমাদের সমাজে মেয়েটাকে যেভাবে শিখিয়ে-পরিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হয় সেভাবে ছেলেটাকে বোঝানো হয় না। যারা বোঝাবে অর্থাৎ ছেলের পরিবার নিজেরাই তো ভেবে বসে থাকে যে, আমরা ছেলে পক্ষ, বিশাল কিছু। অথচ এতটুকু কাজের জন্য পরবর্তীতে কত বড় মাশুল দিতে হয় দুই পরিবার আর তাদের সন্তানদের। এটা বোঝার মতো অবস্থা এখনও আমাদের সমাজে তৈরি হয়নি।
 
এখন অনেক সিঙ্গেল মাদার দেখা যায় আশপাশে। আগের মতো হয়তো অতটা চমকে ওঠার মতো ঘটনা এটা না। বাড়িওয়ালারাও আগের চেয়ে একটু নমনীয় হয়েছেন। তাদের ঘরের মেয়েটিও হয়তো এমন জীবনযাপন করছে বলে তাদের এই উপলব্ধি। তবু কি সিঙ্গেল মায়েরা ভালো আছেন! একা সংসার সামলানো, সন্তান মানুষ করা হয়তো সহজ কিন্তু সিঙ্গেল মায়ের তকমা লাগিয়ে সমাজে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন এবং এই কঠিন অবস্থা মানুষেরই তৈরি। একজন নারী যখন একটা অসুস্থ সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসে তার মানে কিন্তু এই নয় যে, সেসব রকম সম্পর্কের প্রতি বিরক্ত। সে স্পেসিফিক সেই সম্পর্কের প্রতি বিরক্ত যে সম্পর্ক তাকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করছিল না। তার কোনো স্বাধীনতা ছিল না। তার প্রতিটা মুহূর্ত মৃত্যুকূপ হয়ে উঠছিল। তাই সে এ রকম একটা টক্সিক সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হয়তো সে নিজে ভালো থাকার জন্য নয়তো তার আদরের সন্তানকে ভালো একটা পরিবেশ দেওয়ার জন্য। তা হলে সিঙ্গেল মায়েদের ভিন্ন জগতের প্রাণী ভাবার তো কোনো কারণ নেই। ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার সবার আছে। আমাদের সমাজে এমন অনেক পরিবার আছে যে পরিবারে স্ত্রী সন্তান জন্ম দিতে পারছে না বলে অথবা স্ত্রী সময় দিতে পারছে না বলে স্বামীর আরেকটি বিয়ে করে আনার অধিকার রয়েছে। কিন্তু একই রকম ঘটনা যদি স্বামীর দ্বারা ঘটে তা হলে একজন স্ত্রী কিন্তু এই বিষয়টা ঘটাতে পারে না। আমাদের সমাজের এটার বৈধতা নেই। সুতরাং নারী নীরবে অথবা সরবে স্বামীর সংসার ত্যাগ করে।
 
আমাদের সমাজে সিঙ্গল মাদার মানেই ওয়ার্কিং লেডি এবং এটাই ধ্রুব সত্য। কারণ সিঙ্গেল মায়ের তকমা নিয়ে নিজের ঘরে টিকে থাকাটাও দায় হয়ে পরে। তাই মা-বাবার অবস্থা ভালো হলেও একজন সিঙ্গেল মা চেষ্টা করেন নিজের ইনকামে সন্তানদের লালন-পালন করতে। এখানেও আমাদের পরিবার-সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়। সমস্যা না থাকলেও যেন সমস্যা! মায়ের চেয়ে মাসির দরদের মতো করেই এরা বলতে থাকেন, মা চাকরি করলে সন্তান কীভাবে মানুষ হবে! ঘরে থেকেই তো আজকাল সন্তান ঠিকমতো লালন-পালন করা যায় না। আবার এমন কথাও বলতে শোনা যায় অনেককে যে, একা মা সন্তানকে সময় দিতে চান না বলেই বাইরে চাকরি করতে যান। সন্তানের প্রতি একলা মায়ের ভালোবাসার পরীক্ষা নিতেই যেন ব্যস্ত আশপাশের লোকজন। আমি দেখেছি, সিঙ্গেল মায়েদের জন্য দুটি কমন প্রশ্ন সবসময় তৈরি থাকে। একটি হলো, সন্তান কার সঙ্গে থাকে? যদি সন্তান মায়ের সঙ্গে থাকে তা হলে দ্বিতীয় প্রশ্ন হয়, ওরা কেমন আছে? অথচ একবারের জন্য উচ্চারিত হয় না, তুমি কেমন আছো?
 
সিঙ্গল মাদারদের লোকে একটু বেশি সাহসী মনে করে ফেলেন, এটাও দেখেছি। মনে করেন, একা যখন দায়িত্ব নিয়েছে সন্তান মানুষ করার, তা হলে হয়তো মেয়েটি সবই পারে। তাই তো কাজের ক্ষেত্রে রাত করে মেয়েটিকে একা ছেড়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না। এদের মধ্যেই কেউ কেউ হয়তো এক দিন মেয়েটিকে বুঝিয়েছিলেন, রাতে মেয়েরা নিরাপদ নয়। তার সঙ্গেও যে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সে কথাটা তখন অনেকের আর মাথায় থাকে না। সিঙ্গল মাদার মানেই যেন স্বাভাবিকভাবেই সুপারওম্যান। ডিভোর্স হওয়ার পরপর অনেকে ফোন করে বলেন, ‘চিন্তা নেই, আমরা আছি পাশে।’ শেষে দেখা যায়, সন্তানের অসুখ থেকে শুরু করে নিজের মন খারাপ পর্যন্ত সবকিছু মা একাই সামলাচ্ছে।
 
বিধবাদের জন্য যদিও বা কিছুটা সহানুভূতি থাকে, সিঙ্গল মাদারদের জন্য তার কানাকড়িও থাকে না। এই শব্দটা শুনলেই যেন জানতেই হবে, ‘সত্যি একা তো? না কি বাইরে কোনো বিশেষ বন্ধু-টন্ধু আছে?’ আর কারও সঙ্গে ওঠাবসা করতে দেখলে তো আর এক কেলেঙ্কারি। কফির টেবিলে কোনো পুরুষের মুখোমুখি বসার দৃশ্যও আশপাশের লোকের কল্পনার জগতে পৌঁছে যায় শোওয়ার ঘর পর্যন্ত। এমন রসালো কানাঘুষার কিছু কিছু যে সিঙ্গল মাদারটির কানে আসে না তা নয়। সব শুনেও মাথা ঠান্ডা রাখাই তার লড়াই।
 
এখন তো অনেক ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিকভাবেও মা তার সন্তানকে বড় করার ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। পৃথিবীতে সব মার ক্ষেত্রেই সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব পরিবারের অন্যদের থেকে অনেক বেশি। মা হিসেবে প্রত্যেকেরই ইচ্ছে থাকে সন্তানকে সুন্দর করে বড় করা, মানুষের মতো মানুষ করা এবং আনন্দের সঙ্গে জীবন কাটানো। আর এসব পেতে হলে যে পুরুষ সঙ্গী থাকাই লাগবে এটা জরুরি বলে অন্তত আমি মনে করি না। বরং এত বড় দায়িত্ব পালন করার সময় একজন ভালো মনের মানুষ পাশে থাকাটা ভীষণ জরুরি। যে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে পাশে থাকবে, দায়িত্বশীল একজন ক্লান্ত-শ্রান্ত মাকে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে রাখবে।
 
আমরা যত আধুনিকই হই না কেন, এখনও আমাদের সমাজে সিঙ্গেল মাদার মানেই বিভিন্ন প্রশ্ন। সিঙ্গেল মাদার মানেই যেন ব্যর্থতা। মাথার ওপর বটবৃক্ষ অর্থাৎ পাশে একজন পুরুষ ছাড়া সন্তানের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা এবং পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠন যেন একেবারেই অসম্ভব। আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই, প্রত্যেক নারীর জীবনে একজন পুরুষের ভূমিকা অপরিহার্য হলেও একজন পুরুষ ছাড়াও আমরা সাফল্য অর্জনের ক্ষমতা রাখি। সন্তানকে সঠিক পথ দেখাতে একজন মা-ই যথেষ্ট। আমাদের মধ্যে অনেক সিঙ্গেল মাদার রয়েছেন, যাদের শক্তিশালী মনোবল ও সাহসী উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আবার কেউ কেউ সিঙ্গেল মাদার হিসেবে সন্তানদের সঠিক পরিচর্যায় হিমশিম খান।
 
সিঙ্গেল মাদার হিসেবে আপনার প্রথম দায়িত্ব, সন্তানের মানসিক ও বাহ্যিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করা। একটি পুস্তকের মতো সন্তানকে পড়তে ও জানতে হবে। আপনার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে বা আলাদা থাকছেন, আপনি হতাশায় ভুগছেনÑএসব বিষয় স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রাধান্য হলো, আপনার সন্তান এই নতুন পরিবর্তনটা কীভাবে নিচ্ছে তা অনুধাবন এবং পরিস্থিতি মানাতে সহায়তা করা। সন্তানের সঙ্গে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকুন। নয়তো আপনার হতাশা, উদ্যোগ তাকে আরও হতাশ করবে।
 
সন্তানের সঙ্গে বিশ্বাস স্থাপন করুন। একটা বয়সে আমাদের সন্তানরা কথা শুনতে চায় না। পরিবারে বাবা না থাকলে সেটা আরও প্রকট হয়। বন্ধু, পরিবেশে মেলামেশায় অনেক সময় তারা ভালো-মন্দ বিবেচনায় রাখতে পারে না। তার ওপর পারিবারিক ভাঙনে তারা আরও অনিরাপত্তায় ভোগে। তাই, অনেক দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে সন্তানকে বুঝতে দিতে হবে, যেকোনো সমস্যা বা বিপদে আপনিই তার নিরাপদ আশ্রয়। এতে করে আপনার সন্তান ঘরে-বাইরে ঘটে যাওয়া অনেক কিছু আপনার সঙ্গে শেয়ার করবে এবং আপনি তাকে ভালো-মন্দ বিবেচনায় দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন।
 
সিঙ্গেল মাদারদের সবসময়ই উপার্জন ও খরচের ব্যাপারে খুব হিসাব কষে চলতে হয়। বাচ্চারা অনেক সময় অন্যের কিছু দেখে বায়না ধরে বা অপ্রয়োজনীয় আবদার করতে ভালোবাসে, যা একজন সিঙ্গেল মাদারের পক্ষে সবসময় দেওয়া সম্ভব হয় না। বিষয়টি সিঙ্গেল মাদারকে বেশ আঘাত করে। তাই সন্তানকে নিজের উপার্জন সম্পর্কে জানান। বাচ্চারা পরিবারে অধিকারী হতে পছন্দ করে। মাসিক খরচের একটা চার্ট তাকে করতে দিতে পারেন। কত উপার্জন হলো, এ মাসে কত খরচ হবে, কত বাকি থাকবে বা কত সংরক্ষণ থাকবে- তার হিসাব যখন আপনার ছোট বাচ্চাটিকে পাশে নিয়ে করবেন এবং কৌশলে তাকেও কিছু দায়িত্ব দেবেন, তখন আপনার সন্তান যোগ-বিয়োগের অঙ্কে দক্ষ হয়ে উঠবে। নিজেই অপ্রয়োজনীয় জিনিসে অর্থ খরচ বা অহেতুক বায়না করা থেকে বিরত থাকবে। শিশুটি দেখে দেখে দায়িত্বশীল হবে। সিঙ্গেল মাদাররা সবসময়ই শক্তিশালী হন। তারা ধৈর্য, চেষ্টা, লক্ষ্য, পরিশ্রম ও সাহসের সঙ্গে সুখ, আনন্দ ও প্রাপ্তিতে সফল হন। তবে একেকটা সন্তান একেক রকমের আবেগ, চিন্তা, বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মায়। প্রতিটি সিঙ্গেল মাদারের জীবনযাপন, ভাবনা ভিন্ন হয়। সবার জন্য একই প্রয়োগ কার্যকর নাও হতে পারে।
 
এটা সর্বান্তকরণে সত্য যে একা সংসার, সন্তান সামলানো কঠিন। কিন্তু সম্ভব না এটা ভাবাটা বোকামি। সন্তানকে ভালো করে মানুষ করার থেকে বড় কাজ একজন মায়ের কাছে আর কিছু হতে পারে না। সামাজিক নিরাপত্তার জন্য স্বামী বা সন্তানের বাবার প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় নিজের আত্মসম্মান বা অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে নিজের অন্তরকে ছোট করার দায়ভার সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। সন্তানকে মানুষ হিসেবে তৈরি করতে গেলে একজন নারী এবং একজন পুরুষ উভয়কেই একে অন্যকে সম্মান করার পাশাপাশি দুজনের প্রতি দুজনকে বিশ্বাসী এবং দায়িত্ববান হওয়া অপরিহার্য। এখানে মতের অমিল যদি ধ্বংসাত্মক অবস্থার রূপ নেয় তা হলে সন্তানের ভালোর জন্যই আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো।
 
আমাদের সমাজের মানুষ আসলে চিন্তা শক্তির খুব একটা গভীরে প্রবেশ করে না বা করতে পারে না। তাই সহজেই মানুষের সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান নিয়ে কথা বলে। যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজে বা নিজের পরিবারের কেউ ওই জায়গাটায় পৌঁছতে পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যের যেকোনো পরিস্থিতি সম্পর্কে সহজে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। তাই সিঙ্গেল মাদারদের উচিত অন্যের কথা গায়ে না লাগিয়ে নিজের জন্য যেটা ভালো সেটাই করে যাওয়া।
 
লেখক: নারী অধিকারকর্মী
spot_imgspot_img

ছবিটা তুলে রাখুন ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে : ড. ইউনূস

গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগে করা মামলায় জামিন পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।...

মায়ের ঘুমপাড়ানি সুর শান্তিধারা

আমাদের জোনাকজ্বলা গ্রাম বিদ্যুৎ তখনও দেখেনি। সন্ধ্যার কাছে বিকেল নতজানু হতেই সবুজ পাহাড়েরা মিশকালো হয়ে যায়। ফলে- আমরা চালের ফুটো দিয়ে চাঁদ দেখি, আর...

মাহবুবা ফারজানা নতুন তথ্য সচিব

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বেগম মাহবুবা ফারজানা। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ছিলেন। তাকে সচিব পদে পদোন্নতি...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here