অর্থভুবন প্রতিবেদক
প্রতারণার মাধ্যমে পাওয়া টাকার গন্তব্য আড়াল করতে মৃত ব্যক্তিদের নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন করেছে প্রতারকরা। দুটি মামলার তথ্যানুন্ধানে জানা গেছে এসব। মামলা দুটি তদন্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সংস্থাটি পাঁচ বছর আগে মারা যাওয়া আতাউর রহমান (৫০) নামে এক ব্যবসায়ীর কাগজপত্র দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার তথ্য পান। তার মৃত্যুর দুই বছর পর তার নামের ওই অ্যাকাউন্টে এক বছরেই লেনদেন হয় ৬৫ লাখ টাকার বেশি। এমন অসংখ্য ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নাইজেরিয়ান প্রতারকরা।
২০২০ সালের ৫ আগস্ট প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুই বাংলাদেশিসহ চার নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করে র্যাব। ৭ আগস্ট রাজধানীর কাফরুল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়। ওই সময় টাকা জমা দেওয়ার কয়েকটি ব্যাংক স্লিপ পাওয়া যায়। পরে এ মামলার তদন্ত সিআইডিতে পাঠানো হয়। এর আগে একই বছরের ২০ জুলাই রাজধানীর পল্লবীতে অভিযান চালিয়ে এক বাংলাদেশি নারীসহ ১২ নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করে সিআইডি। পার্সেল পাঠানোর নামে আত্মসাতের লাখ লাখ টাকা লেনদেনের তিনটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়।
সিআইডি সূত্র জানায়, এসবের মধ্যে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে গিয়ে জানা গেছে, এটি আতাউর রহমানের। সেখানে ইন্ট্রোডিউস অ্যাকাউন্ট দেওয়া হয়েছে তার স্ত্রী মিনাক্ষী সুলতানার। আর আতাউরের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে ৬৪ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৬ টাকা। টাকা উত্তোলনের সময় কোনো চেক ব্যবহার করা হয়নি। সব টাকা তোলা হয়েছে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে। সিআইডির এসআই নিউটন কুমার দত্ত এ প্রতিবেদককে জানান, দুটি মামলায় গত বছরের ৩০ এপ্রিল আদালতে ১৩ নাইজেরিয়ানসহ মোট ২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আর মিনাক্ষী জানিয়েছিলেন- তার স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। কিন্তু তার নামে থাকা অ্যাকাউন্ট কারা ব্যবহার করছিলেন তা তিনি জানতেন না। পরে আতাউরকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়। সিআইডি সূত্র জানায়, এ বি সিদ্দিকী একটি চীনা কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে চাকরি করতেন। মারা যাওয়ার আগে তিনি কেভিন চেনের অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘টিএনএস’ ও ‘বরগাটা’য় কিছুদিন এমডির দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুবাদে এ বি সিদ্দিকীর জাতীয় পরিচয়পত্রসহ তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য ও কাগজপত্র কেভিনের কাছে ছিল। এ বি সিদ্দিকী মারা যাওয়ার এক মাস পর তার নামে মোবাইলফোনে আর্থিক সেবাদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান বা এমএসএফের ‘মার্চেন্ট’ হিসাব খোলেন কেভিন। অবৈধ সুবিধা নিয়ে এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন এমএসএফ প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা। কেভিনের সহযোগী হিসেবে ওই এমএসএফ কোম্পানির সেই কর্মকর্তা এস এম আবু সায়েমকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বি সিদ্দিকীর নামে অ্যাকাউন্ট রয়েছে, সেটা জানতেন না তার পরিবারের সদস্যরা। তদন্তের শুরুতে তার ছেলেমেয়েকেও হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা। সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, এ ধরনের প্রতারণা বন্ধে এমএসএফ হিসাব খোলার ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানোর বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, মৃত ব্যক্তির নামে ‘মার্চেন্ট’ হিসাব খুলে সেটি ব্যবহার করছিলেন চীনা নাগরিক কেভিন। মাত্র ১৪ দিনে ২৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। অস্বাভাবিক এই লেনদেনের সূত্র ধরে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা জানতে পারেন, এ বি সিদ্দিকী নামের এক ব্যক্তির নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে হিসাবটি খোলা হয়েছে। তবে হিসাব খোলার এক মাস আগেই মারা গেছেন মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা এ বি সিদ্দিকী। কেভিন প্রায় তিন বছর ধরে নতুন নতুন অ্যাপ বানিয়ে ঋণ ও বিনিয়োগের ফাঁদে ফেলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক। আর তিন বছর আগে বাংলাদেশে আসেন কেভিন চেন। তিনি ‘পিসেস টেকনোলজি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন অ্যাপ তৈরি করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করেন। নতুন অ্যাপ খুলে ছয় মাস থেকে এক বছর চালাতেন। বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করার পর সংশ্লিষ্ট অ্যাপটি বন্ধ করতেন। আবার নতুন অ্যাপ চালু করতেন। এভাবে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন কেভিন। এ ঘটনায় আবু তালহা নামে এক ভুক্তভোগী চলতি বছরের জানুয়ারিতে পুরান ঢাকার চকবাজার থানায় মামলা করেন। সেই মামলার তদন্তে নেমে সিআইডি এক চীনা নাগরিকসহ ১২ জনকে শনাক্ত করে। তাদের মধ্যে ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে পালিয়ে যান চক্রের হোতা চীনা নাগরিক কেভিন চেন (৪০)। তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় আরেকটি মামলা রয়েছে বলেও জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে পাখি বিক্রি করতেন কায়েস হোসেন। এক নাইজেরিয়ানের সঙ্গে পরিচয়ের পরই ভাগ্য খুলে যায় তার। নাইজেরিয়ানদের পার্সেল প্রতারণায় সহযোগিতা করে হয়েছেন কোটিপতি। তার অন্তত ১৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ কোটির বেশি টাকার খোঁজ পেয়েছে সিআইডি।
কায়েসের বিষয়ে সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, কায়েস দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের অ্যাকাউন্টের তথ্য সংগ্রহ করে রাখত। পরে অ্যাকাউন্ড হোল্ডারকে চার থেকে পাঁচ শতাংশ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সংগ্রহ করা হতো তাদের চেক বইসহ প্রয়োজনীয় তথ্যাদি।