অর্থভুবন প্রতিবেদক
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ধলই চা-বাগানের মালিক শিল্পপতি রাগীব আলী। ২০২২ সালের জুন মাসের শেষ দিকে একদিন রাতের আঁধারে মুখোশ পরা একদল লোক এই চা-বাগানের অফিস কক্ষে আগুন দেয়। পুড়ে যায় হিসাবরক্ষকের কক্ষের সব নথিপত্র। দুই নৈশপ্রহরী বাধা দেওয়ায় তাঁদের বেঁধে ফেলে রাখে দুর্বৃত্তরা। আগুনে দগ্ধ হন তাঁরাও। তাঁদের একজন কিছুদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
আগুনের ঘটনায় মামলায় গত ৭ জুলাই অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের ৩০ জুন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অফিস অডিটের দিন ধার্য করেন। আব্দুল কাদির কোনো উপায় না পেয়ে অডিট শুরুর আগের দিন সব তথ্য মুছে দিতে চার-পাঁচজনকে ভাড়া করেন অফিসে আগুন দিতে। আগুন দেওয়ার সময় বাধা দিলে নৈশপ্রহরী প্রসাদ পাশী ও নারায়ণ রাজভরকে মারধর করে বেঁধে ফেলে রাখে দুর্বৃত্তরা। পরে অফিস কক্ষে আগুন দেওয়া হয়। এতে দগ্ধ হন দুই নৈশপ্রহরী। তাঁদের একজন পরে মারা যান।
ধলই চা-বাগানসংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, দেবোত্তর সম্পত্তি আত্মসাতে জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি আদেশ তৈরির অভিযোগে ২০০৫ সালে রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৬ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। এই প্রায় ১১ বছরেই বদলে যায় আব্দুল কাদিরের ভাগ্য। তিনি ছিলেন রাগীব আলীর আস্থাভাজন। আর এ সুযোগে হিসাবরক্ষক হয়েও তিনি ছিলেন বাগানের অলিখিত পরিচালক। বাগানের সব হিসাব, আয়-ব্যয় তাঁর হাতেই ছিল। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে ২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর মুক্তি পান রাগীব আলী। দীর্ঘদিনের আয়-ব্যয়ের হিসাবে গরমিল এবং বাগানের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ আমলে নিয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের শুরুর দিকে আব্দুল কাদিরের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে। এতে বাগানের শতকোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি বেরিয়ে আসে।
আব্দুল কাদিরের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র বলেছে, রাগীব আলী যখন কারাগারে, সে সময়ই আব্দুল কাদির শ্রীমঙ্গল শহরে সম্পদ গড়ে তোলেন। শ্রীমঙ্গল বিজিবি ক্যাম্পের পাশে তাঁর ১২ ফ্ল্যাটের একটি বহুতল ভবন রয়েছে। শহরের পানসি রেস্টুরেন্টের পাশে কিনেছেন জান্নাত টাওয়ার। সেখানে রয়েছে ১৮টি ফ্ল্যাট। মিশন রোডে ডুপ্লেক্স ভবনে তিনি বসবাস করেন। সাইফুর রহমান মার্কেটের সামনে আরাফাত ম্যানশন নামের একটি মার্কেট কিনেছেন আব্দুল কাদির, যার নিচতলায় একটি তৈরি পোশাকের বিপণিবিতান এবং ওপরে গার্মেন্টস রয়েছে। মুসলিমভাগ এলাকায়ও রয়েছে একটি বহুতল ভবন।
একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি আব্দুল কাদিরের ঘনিষ্ঠ। তাঁর চোখের সামনে আব্দুল কাদিরের উত্থান ঘটেছে। এই উত্থান অবাক করার মতো। ওই নেতা বলেন, ‘কোনো মানুষকে ৫০ কোটি টাকা দিয়ে ব্যবসা করতে বললেও রাতারাতি এত টাকার মালিক হতে পারবে না।’শ্রীমঙ্গলের এক পরিবহনশ্রমিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আব্দুল কাদিরের বেশ কিছু গাড়ি ভাড়ায় চলত একসময়। তিনি অনেক অবৈধ টাকার মালিক বলে জনশ্রুতি আছে।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে মুঠোফোনে আব্দুল কাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘ফালতু কথা বলবেন না। আপনি যা পারেন করেন।’ এটুকু বলেই তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, ‘আমি এই থানায় যোগ দেওয়ার আগে মামলাটি হয়। আমি যোগ দেওয়ার পর চা-শিল্পের স্বার্থে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করি। গভীর পর্যবেক্ষণ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা অভিযোগপত্র দাখিল করেছি। আমাদের তদন্তে নিজের অফিসের নথি পুড়িয়ে দিতে আব্দুল কাদিরের নেতৃত্বে আগুন লাগানোর ঘটনাটি উঠে এসেছে।’