অর্থভুবন প্রতিবেদক
রাশেদুল হাসান মুরাদের জন্ম চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌরসভার চাগাচর গ্রামে। তিনি জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। ৩৫, ৩৬, ৩৮, ৪০তম বিসিএসে নন-ক্যাডার পান। তবে রবার্ট ব্রুসের মতোই বিসিএস জয়ের হাল ছাড়েননি রাশেদুল। সবশেষে ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে (ইংরেজি) প্রথম স্থানে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
দোহাজারী পৌরসভার চাগাচর গ্রামে শঙ্খ নদের হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আমার। শৈশবে ইনট্রোভার্ট স্বভাবের ছিলাম, তবে ভালো লাগার বিষয় পেলে উচ্ছ্বসিত হতাম। ইচ্ছা ছিল ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেব। সুযোগ পেয়েছি, ভালো লাগছে। তবে প্রথম হয়েছি, এটা পরিশ্রমের স্বীকৃতি আর আনন্দের বিষয়। পছন্দের বিষয়ে ক্যাডার হলে ভালো লাগে।
স্বপ্ন দেখার শুরু
স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য মনস্থির করি। বিসিএস নিয়ে এর আগে তেমন কোনো স্বপ্ন গড়ে ওঠেনি বা এ ব্যাপারে সিরিয়াসলি ভাবিনি। মূলত বিভাগের বড় ভাইদের পররাষ্ট্র ও প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেওয়ার গল্প শুনতে ভালো লাগত। তাঁরা বিভিন্ন সময় সুন্দর অভিজ্ঞতার কথা বলতেন। মনে হতো, ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দিলে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হব, ক্যারিয়ারে ভালো করা যাবে। একদিন বাংলা বিভাগের আলী ভাই (বর্তমানে চবি শিক্ষক) বললেন, ‘কোচিংয়ে ভর্তি হওয়া দরকার; এলোমেলো পড়ে লাভ নেই।’ তখনই কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে প্রস্তুতি শুরু করি।
যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বিসিএসের ব্যাপারে তেমন ভাবিনি। শেষ পর্যায়ে এসে ভাবছিলাম, এ দেশে চাকরির বাজারে সামাজিক মানমর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তা বিবেচনায় নিলে বিসিএস ছাড়া ভালো অপশন কম আছে। যেসব অপশন আছে, সেসবের কোনোটি আমার পছন্দ নয়, আবার কোনোটির জন্য আমি উপযুক্ত নয়। তা ছাড়া সিজিপিএ কম থাকায় অনেক জায়গায় আবেদন করা সম্ভব ছিল না। কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে প্রথমে সবকিছু দিশেহারা মনে হচ্ছিল। একদিন ম্যাথ মডেল টেস্টে খুব খারাপ করি। তখন খুব জেদ চেপে বসে। দুই সপ্তাহ পরে আরেকটি পরীক্ষার জন্য দিনরাত খেটে পুরো ম্যাথ বই প্র্যাকটিস করেছি। ওই টেস্টে সম্ভবত চতুর্থ হই। এরপর থেকে প্রতিটি বিষয়ে একটি কৌশলই প্রয়োগ করতাম। বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একবার পড়ে ফেলা।
কিছু ভুলে গেলেও অধিকাংশ আইডিয়া মাথায় চলে আসে। অষ্টম ও নবম শ্রেণির বিষয়গুলোর ওপর যার দখল যত ভালো, তার বেসিক তত মজবুত হয়ে ওঠে। এ ছাড়া একাধিক নোট, গাইড ও পত্রিকা পড়া আমি পছন্দ করি। ৩৮তম বিসিএসের বাংলাদেশ বিষয়াবলিতে আমার ১৪৩ নম্বর ছিল। ৩৫তম বিসিএসের ইংরেজিতে ১৪৫ ছিল। এসব অভিজ্ঞতা সম্ভবত এবার ৪১তম বিসিএসে কাজে লেগেছে। কোন বিষয় কীভাবে পড়লে ভালো নম্বর তোলা যায়, সেটা আলাদা করে প্ল্যান করতে হবে। বর্ণনামূলক লেখা, সঠিক রেফারেন্স, টু দ্য পয়েন্টে উত্তর ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা রাখা জরুরি।
যাঁদের অনুপ্রেরণা পেয়েছি
আপু আর ভাইয়া ব্যাপক প্রেরণা জুগিয়েছেন। ছোট বোন রাফি কখন কী লাগবে, সব যত্ন নিত। মা সারাক্ষণ কোরআন শরিফ পড়ে বা নামাজ পড়ে দোয়া করতেন। আমার স্ত্রী মনে মনে খুব চাইত, যেন বিসিএস ক্যাডার হই। কিন্তু আমাকে মানসিকভাবে চাপমুক্ত রাখার জন্য বলত, ‘তোমার বর্তমান চাকরি অনেক ভালো। পরের বিসিএস হলে বোনাস, না হলে কোনো সমস্যা নেই।’
যত বাধাবিপত্তির জয়
চার ভাইবোনের পড়ালেখার ব্যাপারে বাবা-মা খুব উদ্যোগী ছিলেন। যখন যা প্রয়োজন, তা মিটিয়ে দিতেন। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতায় তেমন পড়তে হয়নি। তবে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় বাবা স্ট্রোকে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন এবং বেশ কয়েক বছর সংগ্রাম করে বেঁচে ছিলেন। সেই থেকে আমার জীবন এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। বাবা যখন মারা যান, আমি আর আপু তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। ছোট ভাই কুমিল্লা মেডিকেলে আর ছোট বোন স্কুলে। এমন একটা পরিস্থিতিতে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া ছিল যেমন খুব কঠিন, সেখানে ভাইবোনের দেখভাল করা আরও কষ্টের। তখন বিভিন্ন কোচিংয়ে পড়িয়ে ভালো আয় করতাম। জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে দেখলাম, অনেক আপন মানুষ সরে গেছে। তখন আপু আর ভাইয়া সর্বোচ্চ ভালোবাসা আর সাহস জোগাতেন।
প্রস্তুতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার
জ্ঞান শেয়ার করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া একটা শক্তিশালী মাধ্যম। তবে এর ব্যবহার করতে গিয়ে অনেকে ব্যাপক সময় অপচয় করেন। এই নিয়ন্ত্রণ নিজের ওপর না থাকলে এর থেকে দূরে থাকাই ভালো। তবে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে অনেক কিছু শেখার সুযোগ আছে। আমি নিয়মিত ইউটিউব থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংবাদ দেখতাম। বিবিসি, সিএনএন ও আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে তথ্য সন্নিবেশ করা যায় লিখিত পরীক্ষায়। এ ছাড়া অনেক সফল ক্যাডারদের অভিজ্ঞতা সোশ্যাল মিডিয়ায় পেয়ে উপকৃত হয়েছি। ‘মার্চ ফরোয়ার্ড’-এর কথা তো উল্লেখ করতেই হবে।
নতুনদের জন্য পরামর্শ
স্নাতক পর্যায় থেকেই বেসিক ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করতে হবে, অন্যথায় প্রস্তুতি নিতে দেরি হয়ে যায়। মাধ্যমিক স্তরের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, আইসিটি ও বিশ্ব পরিচয় বইগুলো (ষষ্ঠ থেকে দশম) ভালোভাবে আয়ত্তে রাখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় বাংলা সাহিত্যের প্রধান সাহিত্যকর্ম ও সাহিত্যিক সম্পর্কে কিছু বই পড়ে নিলে। ইংরেজিতে নতুন নতুন শব্দ শিখে গ্র্যামারের প্রশ্ন প্র্যাকটিস করতে হবে। গণিতের মৌলিক বিষয়ে পরিষ্কার থাকতে হবে। প্রচুর ম্যাথ চর্চা করতে হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভাষা শিক্ষায় গবেষণাধর্মী কিছু করার পরিকল্পনা আছে, বিশেষ করে বিশ্বসেরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করব। দেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার ইচ্ছে রয়েছে।