অর্থভুবন প্রতিবেদক
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সিনিয়র সহসভাপতি ও সাবেক ফুটবলার আবদুস সালাম মুর্শেদী এমপি গুলশানের যে বাড়িতে থাকেন, সেটি সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি। বাড়ি বরাদ্দের ক্ষেত্রে চাতুর্যের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যে চিঠির ভিত্তিতে রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (রাজউক) পরিত্যক্ত সম্পত্তি সালাম মুর্শেদীকে বরাদ্দ দিয়েছে, সেটির অস্তিত্বই নেই। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিটি জাল। গত ২৬ সেপ্টেম্বর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো চিঠিতে এ কথা বলা হয়েছে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মোহাম্মদ খাদেমুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, এ মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ইস্যু করা নথি দুদকে পাঠাতে বলা হয়। সংশ্লিষ্ট শাখায় নথির এন্ট্রি রেজিস্টার যাচাই করে এ-সংক্রান্ত কোনো নথি পাওয়া যায়নি। রেজিস্টার পাওয়া গেলেও ওই স্মারকযুক্ত কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি।
জানা গেছে, সালাম মুর্শেদীর অবৈধভাবে বাড়ি দখল নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। রিট আবেদনে বলা হয়, রাজধানীর গুলশান-২-এর ১০৪ নম্বর সড়কে সিইএন (ডি)-২৭-এর ২৯ নম্বর বাড়িটি ১৯৮৬ সালের অতিরিক্ত গেজেটে ‘খ’ তালিকায় পরিত্যক্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত। আবদুস সালাম মুর্শেদী সেটি দখল করে আছেন।
উচ্চ আদালতের আদেশে সালাম মুর্শেদীর বাড়ি দখলের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধান শেষ করে প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল আদালত। এরপর কয়েক দফায় সময় বাড়ানোর পর ১৫ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধান এখনো শেষ হয়নি। ফলে আরেক দফা সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে গত ৯ অক্টোবর।
দুদকের উপপরিচালক ইয়াসির আরাফাত স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়, ১৯৯৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ইস্যু করা নথির জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুদকে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে বলা হয়েছে, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার এন্ট্রি রেজিস্টার যাচাই করে নথিটি পাওয়া যায়নি। রেজিস্টার পাওয়া গেলেও ওই স্মারকযুক্ত কোনো চিঠি নেই। অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করার আগে ওই সময় চিঠিতে স্বাক্ষরকারী তৎকালীন শাখা-১২-এর সাবেক সহকারী সচিব আবদুস সোবহান ও শাখা সহকারী মাহবুবুল হকের স্বাক্ষর বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্লটের মূল নথির পর্যালোচনা প্রয়োজন।
আবেদনে আরও বলা হয়, হাইকোর্টে গত ২৩ আগস্টের শুনানিকালে ১৫ অক্টোবর অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের কথা আইনজীবীর মাধ্যমে দুদককে জানানো হয়েছে। অনুসন্ধান শেষ করে প্রতিবেদন দাখিলে আরও সময় প্রয়োজন। দুদকের টিম অনুসন্ধান দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছে।
গত রবিবার এই মামলার শুনানি হয়েছে বলে জানান দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, কিছু পাওয়া যায়নি। বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা হয়েছে। আদালত অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছে।
দুদক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে সালাম মুর্শেদীর বাড়ি দখলের অনুসন্ধান চলছে। দুদক অনেক দিন ধরে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৯৯৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ইস্যু করা স্মারকসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র চেয়ে আসছিল। নথিপত্র সময়মতো উদ্ধার না হওয়ায় প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা যায়নি। বিশেষ করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দেওয়া চিঠি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অধিশাখা বলেছে, রাজউকের একটি সিন্ডিকেট পরিত্যক্ত সম্পত্তি বরাদ্দের পেছনে রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এমপি সালাম মুর্শেদীকে গুলশানের সম্পত্তি বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি মিথ্যা। সালাম মুর্শেদী, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউকের কর্মকর্তারা দুর্নীতির মামলায় ফেঁসে যেতে পারেন।
রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন সাংবাদিকদের বলেন, ‘গুলশানের ওই বাড়িটি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সম্পদ। রাজউকের সঙ্গে যোগসাজশ করে এটি দখলে রেখেছেন খুলনা থেকে নির্বাচিত এমপি সালাম মুর্শেদী। বাড়িটির মূল্য কয়েকশ কোটি টাকা। হাইকোর্ট রুল দিয়ে নথি তলব করেছে। শুনানি হলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সালাম মুর্শেদীর নামে বরাদ্দ দেওয়া প্লটের মূল নথি পাওয়া যায়নি। যেসব নথি রয়েছে তার সবই ফটোকপি। সে নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্লটটি ১৯৬০ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা রি-রোলিং মিলসকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালের ২০ অক্টোবর প্লটটির ব্যাপারে মালেকা রহমানের সঙ্গে বিক্রয় চুক্তি হয়। ১৯৯৫ সালে মালেকা রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সন্তান মীর মোহাম্মদ হাসান ও মীর মোহাম্মদ নুরুল আফছার দানসূত্রে এ প্লটের যৌথ লিজগ্রহীতা হন। তাদের আবেদনে ১৯৯৭ সালের ৩১ মার্চ প্লটটি সালাম মুর্শেদীর কাছে হস্তান্তরিত হয়। ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর প্লটটি হাসান ও নুরুলের পরিবর্তে হস্তান্তর সূত্রে সালাম মুর্শেদীর নামে নামজারি হয় এবং তিনি হস্তান্তর গ্রহীতা হিসেবে গণ্য হন। ২০০৪ সালে মুর্শেদীকে ইমারত নির্মাণের জন্য নকশা অনুমোদনের ছাড়পত্র দেয় রাজউক।