কবি আবুল হাসান সরকারি চাকরিরতদের ঘুষ খাওয়া আর ‘শনৈঃ শনৈঃ ওপরে’ ওঠার বিপরীতে তার সৎ, সরল ও রোমান্টিক বাবা সম্পর্কে লেখা কবিতায় বলেছিলেন ‘চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ’। তিনি যদি এই মূল্যস্ফীতির বাজারে ওই কবিতাটি লিখতেন, তাহলে হয়তো তিনি লিখতেন মুখ লুকানো নিম্ন আয়ের মানুষ। কবির বাবার উপরি আয় না থাকলেও বাজারে মুখ লুকাতে হতো না তখন, উপরন্তু চামেলী কেনার মনেরও পরিচর্যা করা যেত সেই যুদ্ধোত্তর সময়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত আগস্ট মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯.৯২ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৪ শতাংশ, যা ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বোঝাই যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির চাপে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখন দিশেহারা। কিন্তু সরকারি এই হিসাব আসলে ধনী-গরিব মিলিয়ে গড় হিসাব। চাল, ডাল, তেল, আটাসহ গরিব মানুষের প্রতিদিনের ভোগ্যপণ্যের প্রকৃত বাজারমূল্য হিসাব করলে দেখা যাবে মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষদের ওপর এখন মূল্যস্ফীতির বোঝা আসলে ১০ শতাংশের বেশি হবে।
‘মুখ ঢেকে তারা গরিবের বাজারে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীর তেজকুনীপাড়ায় অবস্থিত গরিবের বাজার। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ৪০ বছর আগে বাজারটির যাত্রা। স্থানীয়দের কাছে বাজারটি ফকিন্নি বাজার নামে পরিচিত। এখানে বিক্রি হওয়া প্রতিটি পণ্যই অন্যান্য বাজার থেকে কিছুটা কম দামের। সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ এই বাজারের ক্রেতা। কিন্তু গেল দুই বছর মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে ভোগ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে। এ অবস্থায় গরিবের জন্য গড়ে ওঠা নিম্নমানের সবজি ও মাছের বাজারে ভাগ বসাচ্ছেন অনেক মধ্যবিত্ত। মুখ লুকিয়ে তারা বাজার করতে আসেন ফকিন্নি বাজারে। মান নয় দাম কমকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
এটা সবারই জানা যে, মূল্যস্ফীতির প্রথম আঘাতটাই আসে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে। তাদের প্রকৃত আয় ও ভোগ কমে যায়। এই সীমিত আয়ের মানুষের মধ্যে দরিদ্র মানুষ যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে এক শ্রেণি আরেক শ্রেণির ওপর চেপে বসে, বিশেষত আমাদের মতো শ্রেণিবিভাজিত ও বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায়। প্রতিবেদনে উঠে আসা ‘গরিবের বাজার’, ‘ফকিন্নি বাজার’ নামকরণ থেকেই এর ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। এই নামকরণই মধ্যবিত্তকে সেখানে অপ্রবেশ্য করে রেখেছে। ফলে মূল্যস্ফীতিতে যখন সে দিশেহারা এবং কম দামের পণ্য খুঁজছে তখন ওই গরিবের বাজারে তাকে যেতে হচ্ছে মুখ ঢেকে। এখানে আমাদের সমাজব্যবস্থার গভীর অসুখের দিকটিও প্রকাশ পায়। আশা করব, এই অসুখ কাটিয়ে মধ্যবিত্ত প্রকাশ্যে আসুক গরিবের বাজারে, দরিদ্র মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করুক বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ও উদাসীনতার কথা।
সরকারি সংস্থা টিসিবির বাজারদরের তালিকায় দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির হার ১০০ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য সবজির ও মাছের গড় মূল্যবৃদ্ধির হার ১০৮ থেকে ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে সব থেকে বেশি বেড়েছে আলুর দাম। বর্তমানে ১০০ টাকা প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হলেও গত বছর একই সময়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা। ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়।
স্মরণ করা যেতে পারে, বাণিজ্যমন্ত্রী নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ। সরকার ভর্তুকি দিয়ে দেশের সবাইকে খাওয়াতে পারবে না। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য দিতে চেষ্টা করি।’ খেয়াল করা দরকার বাণিজ্যমন্ত্রী মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিলেন ঠিকই, কিন্তু দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের বাজার কারসাজি নিয়ে সরকার ও সরকারি সংস্থার তৎপরতা লোকদেখানোর মধ্যেই আটকে আছে, বাজার আর নিয়ন্ত্রণে আসছে না। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিংবা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির যেসব পরিসংখ্যান সামনে আসছে তার সঙ্গে এই দারিদ্র্য ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ মনোযোগের পাশাপাশি নির্বাচনের আগে এর রাজনৈতিক অভিঘাত সম্পর্কেও সরকারের বিশেষভাবে সতর্ক থাকা দরকার।