সাঈদ জুবেরী
বাংলায় ‘সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর’ বলে একটি কথা আছে। এককালে বাক্যটির ভাবসম্প্রসারণও লিখতে হতো শিক্ষার্থীদের। এখনকার শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে ভাবসম্প্রসারণ করা লাগে কিনা, নিশ্চিত নই। কথা হচ্ছে আমাদের অতি প্রশংসা, গুণকীর্তনের যে অভ্যাস দাঁড়িয়ে গিয়েছে সেখানে অতিকথন বা বেশি কথা বলা বাড়ছেই। ‘অতিকথন’ হলো ডাক্তারি ভাষায় একটি রোগের মতো। ভারতীয় উপমহাদেশে এই অতিকথন আমরা দেখে আসছি সেই আদ্দিকাল থেকেই। সাহিত্যে অতিকথন অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই অতিকথন এখন সমাজে বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যে এমন মাত্রায় ছড়িয়েছে যে, তা সংকটও তৈরি করছে। কারণ এর সরলসিধা উদ্দেশ্য থাকে তোষামোদ সোজা বাংলায় তেল মারা। সাধু বাংলাতে এই তোষামোদীদের তৈলবাজ বলা হয়। বাঙালিদের মধ্যে তৈলবাজদের বাড়-বাড়ন্ত দেখে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন, ‘‘পরিতাপের বিষয়, সমাজ রূপান্তরের পরিক্রমায় ‘তেল’ শব্দটির প্রয়োগ নেতিবাচক অর্থে প্রচলিত হয়েছে। কেননা, মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনে যেখানে শক্তি-বিদ্যা ধন-কৌশল প্রভৃতি কোনো কাজে আসে না, তখন ‘তেল’ বেশ কাজ দেয়। ‘তেল’ শব্দটির এখানে তাৎপর্যগত অর্থ দাঁড়ায় মিথ্যা প্রশংসা বা লোক দেখানো স্তুতি। তার মানে, স্নেহ বা শ্রদ্ধা তার চরিত্র হারিয়ে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করলে তা ‘তেল’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। …বাস্তবিকই ‘তেল’ সর্বশক্তিমান। …যে সর্বশক্তিময় ‘তৈল’ ব্যবহার করিতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সব কাজই সোজা, তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না উকিলিতে প্রসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না, বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোনো কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না। যে ‘তৈল’ দিতে পারিবে তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে, আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্নর হইতে পারে।’’
এই তেলবাজরা ‘যত প্রশংসাই করুক না কেন, তাকে হামেশা কমই মনে হবে। এটা উভয় পক্ষের কাছেই যিনি তেল দিচ্ছেন এবং যাকে দেওয়া হচ্ছে। অভিজ্ঞরা অতিকথনকে পরিহার করার পরামর্শ দেন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে। কারণ এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিরই আশঙ্কা থাকে বেশি। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। তাই আমাদের দেশে অতি প্রশংসার নহরে ভাসতে থাকেন ক্ষমতাবানরা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, একাদশ সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় প্রায় ২০ শতাংশ সময় ব্যয় করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রশংসায়। ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ সময় ব্যয় করেছেন সরকারের অর্জন নিয়ে কথা বলে। আর প্রায় ১৮ শতাংশ ব্যয় করেছেন অন্য দলের সমালোচনায়। সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ সময়। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি সংসদে আইন প্রণয়নের কাজে ব্যয় হয়েছে ১৭ শতাংশ সময়।
আমাদের একটা সব দায় কাঁধে নেওয়ার বিষয় আছে, যার নাম সংস্কৃতি। জনপ্রিয় সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন সম্প্রতি এক টক-শোতে বলেছেন সরকারপ্রধানকে প্রশ্ন করার আগে প্রশংসাসূচক যে বিশেষণের স্তুতিবাক্যের ব্যবহার সাংবাদিকরা করে থাকেন এবং রাজনীতির মঞ্চে নেতানেত্রীদের স্তুতিময় ফিরিস্তির উপস্থান সেটা নাকি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। হতে পারে, পালাগান, জারি-সারি কিংবা নামকীর্তনে যে কোনো ব্যক্তির বা বিষয়ের মহিমা প্রচারে বিশেষণের পর বিশেষণ যোগ করে তাকে মহান করে তোলার চল আছে তা থেকে খালেদ মুহিউদ্দীন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। এটা হয়তো সাহিত্যের বা সংস্কৃতির বা লোকধারার একটা বিশেষ চর্চা। কিন্তু তাই বলে বিপুল অর্থ খরচ করে চলা সংসদ অধিবেশনেও এই অতিকথন, অতি প্রশংসা, গুণকীর্তনের নহর?
কেবল সরকারি দল নয়, জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু অধিবেশন চলাকালে গত বছর আক্ষেপ করে বললেন, ‘‘সরকারের অতিমাত্রায় প্রশংসা করার কারণে জনগণ এখন তাদের (জাতীয় পার্টিকে) ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ বলে মনে করে।’’ গত ৫২ বছরে বাংলাদেশ ১১টি জাতীয় সংসদ পেয়েছে। এর মধ্যে সামরিক-আধা সামরিক সরকারের আমলে যেসব সংসদ গঠিত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনার খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনামলে গঠিত সংসদগুলোর কার্যকারিতা আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। দেখা যাবে প্রতিটি সংসদেই এই অতিপ্রশংসার মাত্রা বেড়েছে।
প্রশ্ন হলো, এমপিদের কাজ কী এবং তারা কেন বিতর্কিত হন? স্মরণ করা যেতে পারে, এ বছরের শুরুর দিকে পদ্মা সেতুকে পাঁচটি প্রশ্ন করেছেন জাতীয় সংসদে এমন বক্তৃতা দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন একজন সংসদ সদস্য। এমপি বা মেম্বার অব পার্লামেন্ট মানে যদি হয় আইনপ্রণেতা, তাহলে তারা আইন প্রণয়নে কতটা সময় দেন এবং এই কাজটি করার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা সংসদে কতজন আছেন?
জাতীয় সংসদের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ অধিবেশনে সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, ‘গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখছি আমাদের পার্লামেন্টের মান ক্রমাগতভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে।’ একটি গবেষণার উদ্বৃতি দিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘ওই গবেষণায় দেখা যায়, সংসদে এক ঘণ্টার বক্তৃতায় মানুষের কথা হয় ৩ মিনিট। বাকি সময় নিজের, দলের, দলের নেতার বিষয়ে কথা হয়।
গত বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের উপদেশ দিয়েছেন বাজেট বক্তৃতায় বেশি কথা না বলার জন্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কেউ কেউ বাজেট আলোচনার কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো খেই হারিয়ে ফেলেন। ফলে বাজেট বক্তব্য ঠিকমতো হয় না। বাজেট নিয়ে যুক্তিনির্ভর কথা বলতে হবে। বাজেটের মধ্যে আলোচনা সীমিত রাখতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ও আলোচনায় থাকবে। তবে কিছুতেই অযাচিত কথা বলা যাবে না। প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই’। মন্ত্রীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এ পরামর্শ বা নির্দেশনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
jubarysayeed@gmail.com