১৯৯৭ সাল, মালয়েশিয়ায় আইসিসি ট্রফির ফাইনাল ম্যাচ চলছে। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন বুকে চেপে মুখোমুখি দুই দল। কেনিয়া ও বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে বাংলাদেশের ইনিংস উদ্বোধন করতে নামেন মোহাম্মদ রফিক। বাংলাদেশ দলের সেরা স্পিনার, ব্যাট করেন লোয়ার মিডল অর্ডারে। কিন্তু তিনি কেন ওপরে! উত্তর, দলের প্রয়োজন, তাই। সেই ঘটনার রজতজয়ন্তী পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটও এগিয়েছে অনেক সামনে। মেকশিফট ওপেনারের ওইভাবে আর কখনো প্রয়োজন পড়েনি।
যখন এসে প্রয়োজন পড়ল, এগিয়ে এলেন আরেকজন স্পিনার। মেহেদী হাসান মিরাজ। মিরাজের পরিচয়ে স্পিনার বলাটা ভুল হলো, বলতে হবে অলরাউন্ডার। অবশ্য আরও একটি বিশেষণ দিলে সবচেয়ে জুতসই হয়, ম্যান ফর অল অকেশন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে মিরাজ এখন তাই-ই।
বাংলাদেশের লোয়ার অর্ডারে ব্যাট হাতে মিরাজ তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তবে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি যা করে দেখান তা ছিল অবিশ্বাস্য। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওই ম্যাচে আফিফ হোসেনের সঙ্গে ১৭৪ রানের জুটি গড়েন। ১৮ রানে ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশ ওই ম্যাচ জিততে পেরেছিল এই জুটির কল্যাণেই। এরপর আসে ভারত সিরিজ। প্রথম ম্যাচে নতিস্বীকার করা টপ অর্ডারের দায় নিজের কাঁধে তুলে নেন। পরের ম্যাচে মিরাজের আটে নেমে করা অনবদ্য সেঞ্চুরি নির্ধারণ করে দেয় সিরিজের ভাগ্য। ঘরের মাঠে ভারতবধের কাব্য রচিত হয় আরও একবার।
সবশেষ এশিয়া কাপে তিনি আরও এক কাঠি সরেস। আফগানদের বিরুদ্ধে ওপেনার হিসেবে নেমে তুলে নিলেন ক্যারিয়ার সেরা সেঞ্চুরি। সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশ টপ অর্ডারে দখিনা হাওয়ার মতো শান্তির পরশ নিয়ে এলেন যেন। তারপরে আরও তিনবার ওপেন করেছেন মিরাজ। লাল-সবুজ জার্সিতে কেবলমাত্র চার নম্বর পজিশন ছাড়া ১-৯ এর সবখানে তাকে দেখা গেছে ব্যাট নিয়ে ক্রিজে এসে স্ট্যান্স ঠিক করতে।
আত্মবিশ্বাস আর সাহসে টইটম্বুর এক খেলোয়াড় মেহেদী হাসান মিরাজ। সেই ছোট থেকেই। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ দলকে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে শুরু। ২০১৬ সালে ঘরের মাঠে হওয়া যুব বিশ্বকাপেও তিনি ছিলেন দলের নেতা। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ওইবারই চ্যাম্পিয়ন বনে যাচ্ছিল দেশ। কুয়াশামাখা সেমির দুর্ভাগ্য তা আর হয়নি। বাংলাদেশ তৃতীয় হলেও ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট হয়েছিলেন মিরাজ।
সেই বছরের অক্টোবরেই টেস্ট অভিষেক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। জীবনের প্রথম ইনিংস শেষে তার বোলিং ফিগার ছিল ৬/৮০। দ্বিতীয় টেস্টে আরও দুই ৬ উইকেট শিকারে ইংল্যান্ডরা পায় হারের তেতো স্বাদ। প্রথম অভিযানেই ম্যান অফ দ্য সিরিজ। বাংলার ক্রিকেটে মিরাজের আগমনীবার্তা ছিল এমনই।
বল হাতে দলের ভরসা হয়ে আছেন তখন থেকেই। ব্যাট হাতেও তিনি এখন বাংলার নতুন ব্র্যান্ড। আর সব মিলিয়ে একজন পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার। নিজের সামর্থ্যরে সবটুকু নিংড়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ না করা ক্রিকেটারটির নাম মিরাজ। যেকোনো পরিস্থিতিতে দলের যা চাহিদা, মেটানোর প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে আসেন মিরাজ। হার না মানা এই অদম্য মানসিকতার জন্যই তিনি কোচদের প্রিয় শিষ্য, অধিনায়কের পরিকল্পিত লড়াইয়ের অগ্রসৈনিক।
ভারতের ক্রিকেটে বাঁধনহারা এক উত্তাল যুবকের আগমন ঘটে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। দারুণ কার্যকরী পেস বোলিং, বাজপাখির মতো ফিল্ডিংয়ের দক্ষতা আর ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম বল থেকেই ছক্কা হাঁকানোর সক্ষমতা যুবকটির বিশেষত্ব। চলনে-বলনে-বেশে ভিড়ের মধ্যেও নজর কেড়ে নেয় সেই যুবক। নাম, হার্দিক পান্ডিয়া।
আইপিএলের কল্যাণে ভারত যে কজন ভবিষ্যতের খেলোয়াড় দলে পেয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম। কৈশোরে চলতি ট্রাকে লাফ দিয়ে চেপে গুজরাটের গ্রামে গ্রামে গিয়ে ‘চারশ-পাঁচশ রুপি’তে টেনিস বলের ম্যাচ খেলে বেড়াতেন। সঙ্গে থাকতেন বড় ভাই কুনাল পান্ডিয়া। সেই টাকা দিয়ে কিনতেন ক্রিকেটের সরঞ্জাম। এক রুমের ছোট্ট এক বাসায় থাকতেন। সেখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরের রিলায়েন্স স্টেডিয়ামের ক্রিকেট ভারতের সাবেক ক্রিকেটার কিরন মোরের অ্যাকাডেমি। ৪-৫ বছরের হার্দিক বড় ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিদিন অনুশীলনে যেতেন। এক কোনায় দাঁড়িয়ে অনুকরণ করতেন ভাইকে।
কিছু দিন পরে শুরু হয় হার্দিকের আনুষ্ঠানিক ক্রিকেট যাত্রা, গুরু জিতেন্দ্র সিংয়ের কাছে। লম্বা সময় অনুশীলনের পরেও গুরুর কাছে এসে মিনতি করতেন, ‘থোরা অওর বল খেলনা হ্যায়’ অর্থাৎ ‘আরও কয়েকটা বল ব্যাটিং করতে চাই।’ ২০০৯ সালে অনূর্ধ্ব ১৬ বিজয় হাজারে ট্রফিতে বাড়োরার ২২৮ রানের ইনিংস খেলেন হার্দিক। সেই থেকে শুরু। এরপর বাড়োরা অনূর্ধ্ব ১৯ দলে নিজের জাত চিনিয়ে ২০১৪ আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসে সুযোগ পাওয়া। পরের বছর আইপিএল অভিষেক।
হার্দিক ভারত জাতীয় দলের এমন একজন খেলোয়াড় যিনি অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় দল এমনকি ঘরোয়া নামি প্রতিযোগিতাগুলোতেও খেলেননি। এই তালিকার আর দুটি নাম খুব পরিচিতÑ রবিচন্দ্রন অশ্বিন এবং মাহেন্দ্র সিং ধোনি। ২০১৭ আইপিএলে অলরাউন্ড নৈপুণ্য হার্দিকের জন্য খুলে দেয় জাতীয় দলের দরজা।
রঙ-বেরঙের চুলের স্টাইল, পোশাক-ঘড়ি থেকে গাড়ির প্রতি আকর্ষণ আর বেশ কিছু বিতর্কিত কাণ্ডে পরিচিতি পেয়ে যান ২০১৯ পরবর্তী সময়ে। এরপর দেখতে হয় ইনজুরির করাল থাবা। উচ্ছৃঙ্খল হার্দিক হঠাৎ বদলে যান একটা ফোন কলে। আশিষ নেহরা ফোনে তাকে জানান, গুজরাট টাইটানসের অধিনায়কত্ব করতে হবে তাকে। ২০২২ আইপিএলে হার্দিক দেখিয়ে দেন তার ক্রিকেট মস্তিষ্ক কোন উপাদানে গড়া। প্রথম আসরেই দলকে চ্যাম্পিয়ন করার পর দ্বিতীয় আসরেও ফাইনালে নিয়ে যান। চটপটে থেকে পরিণত বনে যাওয়া এ অলরাউন্ডার এখন ভারতের সবচেয়ে সীমিত ওভারের অধিনায়কত্ব সামলান। এবং সেই কাজটুকু করেন খুব যথার্থভাবেই।
হার্দিক এই বিশ্বকাপে তিন ম্যাচে ৭ উইকেট শিকার করেছেন। কেবল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে নেমে ৮ বলে ১১ রান করে ম্যাচ জিতিয়ে ফিরেছেন। মিরাজের ব্যাটে এসেছে এক ফিফটিসহ ৯৫ রান। আর উইকেট শিকার ৩টি। দুজনের স্বপ্নই দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা। দুই দেশের দুই পরিণত অলরাউন্ডার যখন মুখোমুখি হবেন ক্রিকেট মস্তিষ্কের লড়াইটা জমে উঠবে দারুণভাবে।