অর্থভুবন প্রতিবেদক
প্রিয়াঙ্কা গাইন নড়াইল বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, নড়াইল আব্দুল হাই সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অনার্স, মার্স্টাস পাশ করেন ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজ থেকে। রেজাল্টও ভালোই ছিল। কিন্তু চাকুরিতে ঢোকেননি।
বিয়ের পরেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের শুরু
প্রিয়াঙ্কার স্বামী মোহনকুণ্ডু আগে থেকেই ফ্রিল্যান্সিং করতেন। ২০১৩ সালে প্রিয়াঙ্কা তাঁর কাছ থেকে কাজ শেখেন এবং নিজেই শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। পরিবারের নানা কাজ সামলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের সময় বের করা তাঁর জন্য কঠিনই ছিল।
শুরুতেই বাজিমাত
পাঁচ, ১০ ডলার আয় দিয়ে যেখানে অনেক ফ্রিল্যান্সারের যাত্রা শুরু হয়, সেখানে আপওয়ার্ক থেকে প্রিয়াঙ্কার প্রথম আয় ছিল ৫০ ডলার।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে কিছু হবে না
‘ফ্রিল্যান্সিং করে কিছু হবে না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। সংসারের কাজ করো।’ এ ধরনের কথা শুনেছেন প্রিয়াঙ্কা।
স্বামীই যখন শিক্ষক
প্রিয়াঙ্কার স্বামী মোহনকুণ্ডু একজন সফল ফ্রিল্যান্সার। ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করেন। সে কারণে ফ্রিল্যান্সিং শিখতে প্রিয়াঙ্কাকে বাইরে কোথাও যেতে হয়নি। শেখার প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রিয়াঙ্কা বলেন, আমি সব সময় আমার হাজব্যান্ডকে এই কাজে সাহায্য করতাম। পাশাপাশি আমি দেখতাম কোন কাজ কিভাবে করে। ধীরে ধীরে কাজ শিখে নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করতে সক্ষম হয়েছি এবং আকর্ষণীয় একটি প্রোফাইল তৈরি করতে পেরেছি।
প্রিয়াঙ্কার কাজ
প্রিয়াঙ্কা নানা রকম কাজে ডুবে থাকতে ভালোবাসেন। তিনি ২০১৩ সাল থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং (ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, পিন্টারেস্ট এবং লিংকডইন)-এর কাজ করছেন। ই-মেইল মার্কেটিং, ফেসবুক বিজ্ঞাপন, ইনস্টাগ্রাম বিজ্ঞাপন, গুগল বিজ্ঞাপন, ইউটিউব বিজ্ঞাপন নিয়ে তাঁর কাজগুলো দেশে-বিদেশে হয়েছে প্রশংসিত। আপওয়ার্কে তিনি ডিজিটাল মার্কেটিং রিলেটেড ৫৫৪টি কাজ সফলভাবে করেছেন। বর্তমানে ১৬৯টি চলমান আছে। সময়ের হিসাব করলে আপওয়ার্কে তিনি মোট প্রায় ৪০ হাজার ঘণ্টা কাজ করেছেন। দৈনিক ১৮ ঘণ্টা কাজ করেন প্রিয়াঙ্কা।
১০ জনের টিম
আপওয়ার্কে প্রিয়াঙ্কার একটি ক্লায়েন্ট অ্যাকাউন্ট আছে। এরই মধ্যে তিনি অনেক বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সার নিয়োগ করেছেন। আপওয়ার্ক থেকে তাঁদের ৩০ হাজার ডলার পেমেন্টও করেছেন। প্রিয়াঙ্কার ১০ জনের একটা টিম আছে। বাসায় বসে তাঁরা কাজ করেন। টিম মেম্বারদের নিয়ে তিনি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ করেন। নড়াইলে বিখ্যাত আইটি সেন্টার ‘স্কাইলিংকআইটি’। এই আইটি সেন্টারের প্রধান নির্বাহী প্রিয়াঙ্কা। এখানে কয়েক শ মানুষকে তিনি ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-মেইল মার্কেটিং, সোশ্যাল মিডিয়া, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিকস ডিজাইন শেখাতে ভূমিকা রেখেছেন। ব্যক্তিগতভাবে চারজন ছেলেমেয়ে তাঁর কাছে ফ্রিল্যান্সিং শিখে এখন মাসে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করছে।
ফ্রিল্যান্সারদের জন্য পরামর্শ
প্রিয়াঙ্কা মনে করেন, নারীদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং আদর্শ পেশা হতে পারে। এ জন্য তার কিছু পরামর্শও আছে।
টার্গেট : আপনার কোন বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে এবং আপনি কোন কাজ করবেন তা নির্ধারণ করুন। আপনার আগ্রহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বাজারের চাহিদা রয়েছে এমন কোনো কাজ বেছে নিন।
অনলাইনে পেশাদারভারে উপস্থিত হন : একটি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট, লিংকডইন প্রফাইল এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে নিজের দক্ষতার কথা জানান দিন। নিজের পোর্টফোলিও, ক্লায়েন্ট প্রশংসাপত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন।
নেটওয়ার্কিং হলো মূল : ফ্রিল্যান্সজগতে নেটওয়ার্কিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রিল্যান্সিং ইভেন্টগুলোতে যোগ দিন। অনলাইন গ্রুপগুলোতে যোগ দিন এবং সহকর্মী ফ্রিল্যান্সার, সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট এবং পরামর্শদাতাদের সঙ্গে সংযোগ করুন। একটি শক্তিশালী পেশাদার নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে মূল্যবান সহযোগিতা এবং ক্লায়েন্ট রেফারেল পাওয়া যায়।
লক্ষ্য নির্ধারণ করুন : আপনার ফ্রিল্যান্সিং লক্ষ্য ঠিক করুন। যেমন—কী পরিমাণ আয় করতে চান, কর্মজীবনের ভারসাম্য কিভাবে বজায় রাখবেন সেটা ঠিক করে নিন। নিজের দক্ষতা বাড়ান। আপনার কাজের সময়, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং কাজের সুবিধার জন্য স্পষ্ট বাউন্ডারি সেট করুন।
স্বামী, স্ত্রী দুজনই ফ্রিল্যান্সার হলে সুবিধা
পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ফ্রিল্যান্সিং করলে অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়। কেউ কোথাও ঠেকলে অন্যজন এগিয়ে আসেন। প্রিয়াঙ্কা বলেন, আমি যদি কোনো কাজ না পারি, তাহলে আমার স্বামীর কাছ থেকে সাহায্য নিই। স্বামীর প্রয়োজনে আবার আমি সাহায্য করি। এ জন্য স্বামী এবং স্ত্রী দুজনে ফ্রিল্যান্সিং করলে সফলতা পাওয়া সহজ হয়।
সন্তান কোলে নিয়ে কাজ
প্রিয়াঙ্কার মেয়ের বয়স চার বছর। মায়ের কোল ছাড়া সে ঘুমাতেই চায় না। তাই বলে প্রিয়াঙ্কার কাজ থেমে নেই। তিনি বলেন, আমার মেয়ে কোলে বসে, আমি কাজ করি। সে সব সময় আমার পাশে থাকে। মাঝেমধ্যে কোলে নিয়েও কাজ করতে হয়। তাকে খাওয়ানোর সময়ও আমার কাজ বন্ধ থাকে না।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের টাকায় গাড়ি
ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয়ের ৪৫ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছেন প্রিয়াঙ্কা। নড়াইলে জমি কিনেছেন, সেখানে তৈরি হচ্ছে ছয়তলা বাড়ি।
আয়ের গল্প
শুধু আপওয়ার্ক থেকেই এ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কার আয় দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার। আর সবগুলো মার্কেট প্লেস হিসাব করলে অনেক আগেই আয়ের পরিমান কোটি টাকা পেরিয়েছে। বর্তমানে মাসে তাঁর আয় প্রায় আট লাখ টাকা।
পেয়েছেন অ্যাওয়ার্ড
প্রিয়াঙ্কার ঝুলিতে তিনটি অ্যাওয়ার্ড আছে। নড়াইল জেলার সেরা নারী ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশের আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং মাশরাফি বিন মুর্তজার কাছ থেকে। ‘টপউইমেন ফ্রিল্যান্সার’ হিসেবে ‘ন্যাশনাল টেক অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ তাঁর অন্যতম অর্জন। এশিয়ার সবচেয়ে বড় কনফারেন্স ‘ন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সারস কনফারেন্স’-এ অংশ নিয়েছেন তিনি।
খুলনা বিভাগ থেকে প্রিয়াঙ্কাকে ‘টপউইমেন ফ্রিল্যান্সার’ সম্মাননা প্রদান করা হয়। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) নড়াইল জেলার ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
প্রিয়াঙ্কা নড়াইলে একটি নেতৃস্থানীয় সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করতে চান। তিনি বলেন, পরবর্তী পাঁচ বছরে আমার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের নড়াইলে একটি নেতৃস্থানীয় এজেন্সি প্রতিষ্ঠার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ে আমার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। একই সঙ্গে, বিভিন্ন দেশের ক্লায়েন্টদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আমার কাজের ক্ষেত্র বাড়ানোর লক্ষ্যে নড়াইল এবং আশপাশের এলাকায় একটি শক্তিশালী ফ্রিল্যান্সার বেস তৈরিতে মনোযোগ দেব।