বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মাঝে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য ব্যাপক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এর প্রধান কারণ একজন বিসিএস ক্যাডারের প্রতি সমাজের গ্রহণযোগ্যতা সবার শীর্ষে। সমাজে এমন একটা প্রতিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে, পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার না হলে আপনি সফল নন। অনার্সে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী একাডেমিক পড়াশোনাকে দ্বিতীয় অপশনে রেখে প্রথমে গুরুত্ব দিচ্ছেন বিসিএসের প্রস্তুতিকে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা রাত-দিন এক করে পড়াশোনা করছেন। এক গাদা বই মুখস্থ করছেন। বিশ^বিদ্যালয়ের হল ও লাইব্রেরিগুলোতে গেলেই দেখা যায়, বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরানোর অবকাশ নেই এই তরুণদের। ৪১তম বিসিএসে আবেদন করেছিলেন ৪ লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থী। অথচ নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন মাত্র ২ হাজার ৫২০ জন। হিসাব করলে দেখা যায়, এই বিসিএসে সফল হয়েছেন মাত্র দশমিক ৫৩ প্রার্থী। বাকি ৯৯.৪৭ প্রার্থীকে তার এই দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রম জলাঞ্জলি দিতে হলো। ৪১তম বিসিএসের সার্কুলার হয়েছিল ২০১৯ সালে। আর ২০২৩ সালে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হলো। অর্থাৎ কেটে গেছে চারটি বছর। চার বছরে একটি বিষয়ে অনার্স শেষ করা যায়। দীর্ঘমেয়াদি এই বিসিএসের পেছনে ছুটতে গিয়ে তরুণ প্রজন্ম বেকারে পরিণত হচ্ছে। সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয় ৩০ বছরে। ২৪-২৫ বছর বয়সী অনার্স পাস করা একজন তরুণ ছুটতে থাকেন বিসিএসের পেছনে। একটা বিসিএস না হলে আরেকটিতে চেষ্টা করেন। এভাবে বয়স এসে ঠেকে ৩০-এর কোঠায়। শেষ অবধি বিসিএস বা অন্য কোনো চাকরি না হলে দীর্ঘসময় বিসিএসের পেছনে দৌড়ানো এই তরুণদের পরিণতি হয় খুবই করুণ। ২৪-২৫ বছর বয়সী একজন তরুণের অনার্স শেষ করে কর্মজীবন শুরু করার কথা ছিল। বিসিএসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা না থাকলে হয়তো সে তার পছন্দের পেশায় কর্মজীবন শুরু করতে পারত। একজন বিসিএস পড়ুয়া জানে বেকারত্বের বোঝা কতটা যন্ত্রণাদায়ক। বাড়িতে হয়তো বৃদ্ধ বাবা-মা, অবিবাহিত বোন। এদিকে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করতে হয়। টিউশনি করাতে হয়। কাউকে হয়তো যুক্ত থাকতে হয় কোনো কাজে। যত কিছুই হোক, সব ভুলে পড়াটা চালিয়ে যেতে হয়। একজন বিসিএস পড়ুয়া বছরের দুটো ঈদ, ঘোরাঘুরি, জীবনের আনন্দ সব কিছুই বিসর্জন দেন। পরিবার থেকে চাকরির জন্য তাগাদা থাকে। দীর্ঘসময় চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভোগেন অনেকে। ৪১তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশের পর বেশ কজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। এর মাঝে কয়েকজন ভুগছিলেন বেকারত্বের হতাশায়। আমাদের দেশে একজন তরুণ শিক্ষা লাভ শেষে কীভাবে কর্মজীবনে প্রবেশ করবে, কী হবে তার কর্মজীবন তার ঠিক নেই। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যে বিষয়ে পড়াশোনা করলেন জীবিকার তাগিদে তাকে কর্মজীবন শুরু করতে হয় ভিন্ন একটি বিষয়ে। আজকের এই তরুণরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সমাজের বিভিন্ন পেশায় তাদের কর্মমুখী করে তুলতে না পারলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হুমকির মুখে পড়বে। এই প্রজন্মের কেউ এখন কৃষক হতে চান না, উদ্যোক্তা হতে চান না। অথচ এসব যে কোনো পেশায় যুক্ত হলে স্বাচ্ছন্দ্যে তিনি জীবনযাপন করতে পারতেন। বিসিএসের পেছনে ছুটতে গিয়ে তরুণ প্রজন্ম তার জীবনের মূল্যবান সময় হারিয়ে ফেলছেন। যে তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করবে তারা আজ ছুটছে বিসিএসের গোলকধাঁধায়। সাফল্যের সম্ভাবনা যেখানে খুবই ক্ষীণ সেখানে ছুটে নিজের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করে বরণ করে নিতে হচ্ছে ব্যর্থতার গ্লানি। প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে এই অন্ধকার থেকে মুক্ত না হলে ঝুঁকিপূর্ণ হবে আগামী প্রজন্ম ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
নূরে আলম সিদ্দিকী শান্ত
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা