Friday, January 17, 2025

আমাদের গানের পাখিরা

প্রায় চার যুগ আগের ঘটনা। রমনা পার্কের কাছে বাসা। সে রাতে বাগানঘেঁষা ঘরে জানালার পাশে ঘুমিয়ে ছিলাম। সারা রাত ঘুমের পর ভোরে উচ্চ স্বরে ‘টু-ইট—টু-ইট—টু-ইট—’ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আশপাশটায় খুঁজে বাগানের বেড়ার ওপর দেখলাম আকাশের দিকে মুখ তুলে চমৎকার ভঙ্গিমায় গান গেয়ে চলেছে পুঁচকে এক পাখি। যেন সে আকাশকে গান শোনাচ্ছে, সূর্যকে তাড়াতাড়ি উঠে এসে চারদিকে আলো ছড়িয়ে দিতে বলছে! জোরালো গলার সুকণ্ঠী এই গায়ক এ দেশের আবাসিক পাখি টুনটুনি। ছেলেবেলার মতো এখনো প্রায় ভোরে খোদ ঢাকার জিগাতলাতেই ওর গান শুনি।

কোনো কোনো পক্ষীবিশারদের মতে, এ দেশে টুনটুনিই সব পাখির আগে ঘুমভাঙানি গান গায়। এরপর দোয়েল ও চড়ুই। বনে গেলে ভোরে ভ্যাদাটুনি নামে আরেকটি পাখির সুমধুর কণ্ঠ শুনি, যার গানকে অনেকেই ইউরোপের নাইটিঙ্গেলের গানের সঙ্গে তুলনা করেন। দোয়েল, ভ্যাদাটুনি ও চড়ুই চার-পাঁচটি সুরে গান গাইতে পারে। নীলটুনি-মৌটুসিরা গান গায় সূর্য ওঠার পর। ঘুঘু-হরিয়ালরাও তা-ই। কোনো কোনো পক্ষীবিশারদের মতে, সকালে সবশেষে গান গায় ফটিকজল, মুনিয়া ও শ্বেতাক্ষী।

হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মন খুলে গান গাইছে সিঁদুরে লাল মৌটুসি
হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মন খুলে গান গাইছে সিঁদুরে লাল মৌটুসিছবি: লেখক

গ্রাম-বনবাদাড়ে ভোরে পাখির গান শোনা যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শহরে? ঢাকা শহরে পাখি আছে বেশ। এদের মধ্যে গান গাওয়া পাখির প্রজাতিও কম নয়, যেমন টুনটুনি, দোয়েল, চড়ুই, কোকিল, মৌটুসি, শালিক, আবাবিল, ফিঙে, বুলবুলি, হলদেবউ, ছাতারে, মুনিয়া, খঞ্জন, কমলাবউ, রামগাংরা, ফটিকজল, ঘুঘু-হরিয়াল, ডাহুক, বসন্তবাউরি, মোহনচূড়া, কাঠঠোকরা, টিয়া ইত্যাদি।

বিজ্ঞানীদের মতে, বিশ্বের প্রায় ১০ হাজার পাখির মধ্যে অর্ধেকই শাখাচারী বর্গভুক্ত, যাদের গলায় সুরযন্ত্র থাকে। এরাই গায়ক পাখি, যেমন টুনটুনি, দোয়েল, শ্বেতাক্ষী, ফটিকজল, রামগাংরা, লেজনাচুনে, দুধরাজ, ফিঙে, ভিংরাজ, কেশরাজ, সুমচা, কাক, হাঁড়িচাঁচা, তাউড়া, হলদে পাখি, হরবোলা এবং বিভিন্ন প্রজাতির শালিক-ময়না, বুলবুলি, ছাতারে, কসাই, চটক, ফুটকি, ফিদ্দা, মুনিয়া, মৌটুসি, তুলিকা, চড়ুই-বাবুই-বঘেরি, খঞ্জন ইত্যাদি। বাদবাকি বর্গ ও গোত্রের পাখিরা অগায়ক, যেমন কোকিল, বউ কথা কও, চোখ গেল, বসন্তবাউরি, নীলকণ্ঠ, দিনেকানা, আবাবিল, মোহনচূড়া, কোড়া-ডাহুক ও বিভিন্ন প্রজাতির হরিয়াল-ঘুঘু, কাঠঠোকরা, টিয়া ইত্যাদি।

কিন্তু অনেকেই বিজ্ঞানভিত্তিক গায়ক ও অগায়ক পাখির সংজ্ঞা মানতে নারাজ। যেমন কাক বা হাঁড়িচাঁচাকে কেউ গানের পাখি হিসেবে মানতে চায় না। তেমনি কোকিল, ঘুঘু, বসন্তবাউরি, ডাহুককেও গানের পাখি থেকে বাদ দিতে নারাজ। কাজেই সাধারণের কাছে যে পাখির গলা মিষ্টি, সুরেলা, গানের তাল-লয়-ছন্দ চমৎকার, সুরের ওঠা-নামা ও লম্বা দম আছে এবং যেকোনো গান, ছড়া বা কথার সঙ্গে তার ডাকটিকে অনায়াসে মিলিয়ে নেওয়া যায়, সেটিই গানের পাখি। সেই অর্থে এ দেশের শহর-গ্রাম-বনবাদাড়ে গায়ক-অগায়ক অগুনতি গানের পাখির বাস। সাধারণের সঙ্গে আমিও একই সুরে সুর মেলাতে চাই।

সচরাচর পুরুষ পাখিই গান গাইতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, পাখিদের জোড় বাঁধা, বাসা তৈরি ও প্রজননের সঙ্গে গানের সম্পর্ক রয়েছে। পুরুষের দেহে হরমোনের বৃদ্ধির ফলেই ওরা প্রাণবন্তভাবে গান গায়। গানের সুরের মাধ্যমে নিজেদের বাসা বা আবাসসীমার ব্যাখ্যা দেয় এবং তা অন্যদের কাছ থেকে রক্ষা করে, যা শারীরিক যুদ্ধের বিকল্প ও গানের যুদ্ধ বলে পরিচিত।

এ ছাড়া গানের মাধ্যমে পুরুষ স্ত্রীকে জোড় বাঁধার জন্য আহ্বান জানায়। পাখিদের প্রজনন সাফল্যের পেছনে গানের ভূমিকা রয়েছে। জোড় বাঁধার প্রাথমিক স্তরে গান স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই যৌনচক্রকে সমকালীন করতে উদ্দীপনা জোগায়। অনেক গবেষক বিশ্বাস করেন, পাখিরা শুধু যৌনতা বা আবাস রক্ষার জন্যই গান গায় না, বরং নির্ভেজাল আনন্দের জন্য গায়। উদাহরণস্বরূপ নাইটিঙ্গেলের বিভিন্ন ধরনের সুরের কথা উল্লেখ্য। যৌনচক্র, বাসা তৈরি, শত্রু তাড়ানো বা আনন্দের জন্য ওরা বিভিন্ন সুরের গান ব্যবহার করে।

যেকোনো গায়ক পাখিই কিন্তু জন্মের পরপরই গান গাইতে পারে না, যদিও শব্দ করার ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। গান গাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়। নিউইয়র্কের রকেফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পিটার মারলার প্রথম এটি পর্যবেক্ষণ করেন। এ বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে গান জানার জন্য ছানাকে অবশ্যই বয়ঃসন্ধিক্ষণে বড় পাখির কাছ থেকে তালিম নিতে হবে।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ

spot_imgspot_img

ছবিটা তুলে রাখুন ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে : ড. ইউনূস

গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগে করা মামলায় জামিন পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।...

মায়ের ঘুমপাড়ানি সুর শান্তিধারা

আমাদের জোনাকজ্বলা গ্রাম বিদ্যুৎ তখনও দেখেনি। সন্ধ্যার কাছে বিকেল নতজানু হতেই সবুজ পাহাড়েরা মিশকালো হয়ে যায়। ফলে- আমরা চালের ফুটো দিয়ে চাঁদ দেখি, আর...

মাহবুবা ফারজানা নতুন তথ্য সচিব

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বেগম মাহবুবা ফারজানা। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) ছিলেন। তাকে সচিব পদে পদোন্নতি...

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here