নারীদের প্রজননতন্ত্রের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে-অ্যান্ডোমেট্রিয়োসিস। মেনোপজ হয়নি; এমন যে কোনো নারীর এ রোগ হতে পারে। এটি কোনো সংক্রামক রোগ নয়। ৯ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের জরায়ুতে যে অ্যান্ডোমেট্রিয়াল লাইন থাকে, তার কোষ জরায়ুর বাইরে ফেলোপিয়ান টিউব, ডিম্বাশয় অথবা পাউচ অব ডগলাসে লেপটে বসে থাকলে তাকে অ্যান্ডোমেট্রিয়োসিস বলে। মাসিকের সময় অ্যান্ডোমেট্রিয়াম যেমন ফুলে ওঠে, তেমনি বাইরের ডিম্বাশয়, ফেলোপিয়ান টিউব ও পাউচ অব ডগলাস এসব অঙ্গের ওপরও রক্তের চাকা তৈরি হয়।
* লক্ষণ
▶ তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা, মাসিক শুরুর চার দিন আগে থেকে যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা শুরু হওয়া, কারও কারও প্রচুর রক্তপাত হতে পারে।
▶ যৌন মিলনের সময় বা পরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হওয়া।
▶ কোমরের তলদেশ পেলভিসে একটানা ব্যথা চলতেই থাকে।
▶ সন্তান ধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ এ রোগ হলে মেনোস্ট্রিয়াল প্যাটার্ন পরিবর্তন হয় এবং এর ফলে বন্ধ্যাত্ব চলে আসে।
▶ মূত্রথলি বা পায়ুপথে ব্যথা হতে পারে। এ পথে অস্বাভাবিক রক্তপাত হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। ফলে একজন নারীর স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। তিনি সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন, হতাশায় ভুগতে শুরু করেন। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো লক্ষণ নেই অথচ পরীক্ষা করলে অ্যান্ডোমেট্রিয়োসিস ধরা পড়ে।
* রোগ নির্ণয়
এ রোগটি নির্ণয় একটু কঠিন। এতে উপসর্গের বৈচিত্র্য যেমন দেখা যায়, তেমনি উপসর্গহীন অ্যান্ড্রমেট্রিয়োসিস হয়। প্রথমত ক্লিনিক্যাল অর্থাৎ পেটের কোথায় ব্যথা আছে তা জানতে চিকিৎসক পারভ্যাজাইনাল পরীক্ষা করে দেখেন। পাউচ অব ডগলাসে টেন্ডার নডিউল বা রক্তের চাকা জমে থাকলে জরায়ুর স্বাভাবিক নড়াচড়ায় ব্যাঘাত ঘটে। আর যেসব পরীক্ষা করতে হয় সেগুলো হলো-আল্ট্রাসাউন্ড ও ডায়াগনস্টিক ল্যাপারোস্কোপি। আল্ট্রাসাউন্ড এক ধরনের স্ক্যান। তবে এ পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক সময় নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না যে, রোগীর অ্যান্ডোমেট্রিয়োসিস আছে।
অ্যান্ড্রোমেট্রিয়োসিস নির্ণয়ের নিশ্চিত উপায় হল নাভির মধ্যে ছোট্ট একটি ফুটো করে টেলিস্কোপের মতো দেখতে যন্ত্র, যাকে ল্যাপারোস্কোপ বলে তা পেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এটি একটি ঝুঁকিহীন অস্ত্রোপচার। এ পরীক্ষায় অ্যান্ড্রোমেট্রিয়োসিস রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে পারে, এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করা যায়।
* চিকিৎসা
চিকিৎসা পদ্ধতি দুই ধরনের, একটি ওষুধের মাধ্যমে আরেকটি সার্জারির মাধ্যমে। অস্ত্রোপচার ছাড়াও বেশ কিছু পদ্ধতিতে এ রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। প্রথমত নন-স্টেরয়েড এন্টিইনফ্লামেটরি ড্রাগ দিতে হয় ব্যথা উপশমের জন্য। দ্বিতীয়ত, মাসে ২১টি ওরাল কনট্রাসেভটিপ পিল দেওয়া হয়। এতে থাকা ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোন যৌথভাবে অভুলেশন দমিয়ে দেয়। ফলে অল্প সময়ের জন্য মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে ব্যথারও কিছুটা উপশম হয়। তৃতীয়ত, মিরেনা বা ইন্ট্রা-ইউটারাইন ডিভাইস-এটি ছোট্ট ডিভাইস, যা জরায়ুতে ঢোকালে তা ধীরে ধীরে প্রজেস্টেরন নিঃসরণে সাহায্য করে। ফলে রক্তক্ষরণের মাত্রা কমে যায় এবং ব্যথাও কমে। এছাড়া গোনাডোটপিন রিলিজিং হরমোন এগোনিস্ট, বর্তমানে খুব বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এরা অস্থায়ী মেনোপজ তৈরি করে ও ব্যথা কমায়। তবে যারা বাচ্চা নিতে চান, তাদের জন্য এ চিকিৎসাগুলো উপযুক্ত নয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এ রোগাক্রান্ত অঞ্চলগুলোকে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। এটি অনেক সময় গর্ভধারণের সহায়তা করে। যারা বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য উত্তম চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে-টেস্টটিউব পদ্ধতি বা আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে বাচ্চা গ্রহণ করা। এছাড়া যাদের বাচ্চার দরকার নেই তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় জরায়ু কেটে ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। খেলাধুলা বা শরীরচর্চা করলে অ্যান্ডোমেট্রিয়োসিসের যন্ত্রণা অনেক কম অনুভূত হয়। দুগ্ধজাত দ্রব্য, রেড মিট, কফি ও গম থেকে তৈরি খাবার এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। ঋতুচক্রের সময় পেটে ব্যথা অনুভব করলেই তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
লেখক : ফারটিলিটি কনসালট্যান্ট ও গাইনোকোলজিস্ট, বিআইএইচএস জেনারেল হসপিটাল, মিরপুর-১, ঢাকা।