জাম্বিয়ার উপকূল জাঞ্জিবার। ভারত মহাসাগরের একটি বড় পর্যটনকেন্দ্র। মাছ ধরা এবং সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদনের জন্য বেশ পরিচিত। এক সময় এই উপকূলীয় সম্প্রদায়ের মানুষ তীব্র দারিদ্র্যে জর্জরিত ছিল। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খেত। হঠাৎ সমুদ্র স্পঞ্জ চাষের প্রবর্তন তাদের অন্ধকার জীবনে আশার আলো নিয়ে আসে। আয়ের পথ সৃষ্টি করে। ঘুচিয়ে দেয় কালো রাত। সাগরের স্পঞ্জ বিক্রির পয়সায়ই অভাবের সংসারে এখন সুদিনের ঢেউ গুনছে জাঞ্জিবারের নারীরা।
জাঞ্জিবারে প্রথম সুদিনের সূর্য ওঠে ২০০৯ সালে। মেরিন কালচারস নামক একটি অলাভজনক স্পঞ্জ ফার্মিংয়ের আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে। দরিদ্র নারীদের উপার্জনের পথ খোলাই ছিল প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠাতা ক্রিশ্চিয়ান ভ্যাটারলাউস বলেন, ‘আমি মনে করি সমুদ্রে চাষ করা একটি ভালো জিনিস।’ ২০০০ সালের গোড়ার দিকে সামুদ্রিক শৈবাল শিল্প ছিল জাঞ্জিবারের স্থানীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। যেখানে ২০ হাজার নারী কৃষক তাদের আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছিল। জীবনযাত্রার মান এবং সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সামুদ্রিক শৈবাল শিল্প ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভ্যাটারলাউস বলেন, এই পরিস্থিতি জাঞ্জিবারের হাজার হাজার কৃষকের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলে। যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, শক্তিশালী বাতাস এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে এই অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবালের ফলন এবং গুণমান ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ জন্য ভ্যাটারলাউস আয়ের উৎস হিসাবে সামুদ্রিক স্পঞ্জের ফার্মিং পদ্ধতি চালু করেন। সামুদ্রিক শৈবাল জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সামুদ্রিক স্পঞ্জের ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ নাই বললেই চলে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই উপকূলের নারীদের জন্য সামুদ্রিক স্পঞ্জ চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠেছে। স্থানীয় নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, ‘সি স্পঞ্জ ফার্মিং জাঞ্জিবারে নারীদের দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।’ জাঞ্জিবার উপকূলের জাম্বিয়ানি গ্রামের রাজাবু (৩১) ফার্মে কাজ করেন। পরিবার পড়াশোনার খরচ বহন করতে না পারায় ১৭ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেন। আর্থিক সংকটের টানাপোড়েন তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নকে চূর্ণ করে দেয়। বিয়ের নয় বছর পর স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। রাজাবু ২০২০ সালে চাকরি খোঁজার জন্য মেরিন কালচারের কাছে যান। তাকে দ্রুত কাজের সুযোগ দেওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি উচ্চ আয় শুরু করেন। রাজাবু বলেন, ‘কাজটা কিছুটা কঠিন হলেও আমি এটি উপভোগ করি। এটি বেশ ভালো অর্থ প্রদান করে যা আমার পরিবারের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট।’ তিনি এখন ২৫০,০০০ তানজানিয়ান শিলিং (১০০ ডলার) মাসিক বেতন পান। চার সন্তানের মা হাজি (৪৮) বলেন, ‘আমরা এই উদ্যোগের জন্য খুব গর্বিত। এটি কৃষকদের আয়ের উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে।’ আরও বলেন, স্থিতিশীল আয়ের জন্য পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের প্রভাব বেড়েছে।
স্পঞ্জ সংগ্রহ শুরুর আগে সাগরের হালচাল বুঝতে প্রথমেই সামুদ্রিক সংস্কৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নারীদের। খামার পরিচালনাকারী আলী মাহমুদ আলীর মতে, ২০০৯ সাল থেকে ১৩ জন মহিলাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মহিলা কৃষকদের এক বছরের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের মধ্যে নারীদের সাঁতার কাটা, ডাইভ করা, সরঞ্জাম ব্যবহার করা, স্পঞ্জগুলো পরিষ্কার ও যত্ন নেওয়া, বিক্রয়ের জন্য স্পঞ্জগুলোকে বিপণন এবং গ্রেডিং করা শেখানো হয়। স্পঞ্জগুলো সাবধানতার সঙ্গে কেটে নিয়ে ব্যারেলে রাখা হয়। সূর্যের তাপে যাতে শুকিয়ে না যায় এজন্য সমুদ্রের পানির নিচেই রাখতে হয়। কিছুটা বড় হওয়া পর্যন্ত সেখানেই যত্ন নেওয়া হয়। কিছুদিন পরপর স্পঞ্জগুলোতে আটকে থাকা ব্যাকটেরিয়া পরিষ্কার করা হয়।
সামুদ্রিক স্পঞ্জগুলো মূলত ছোট ছিদ্রযুক্ত সূক্ষ্ম জলজ প্রাণী। স্পঞ্জগুলোতে একটি শেলের মতো স্তর থাকে। ছিদ্রগুলো দিয়ে সাগরের পানিকে ভেতরে ও বাইরে প্রবাহিত করতে দেয়। এগুলো উষ্ণ তাপমাত্রার জন্য অনেক স্থিতিস্থাপক। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্পঞ্জি প্রাণীগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষজ্ঞরা জানান, স্পঞ্জিগুলো সমুদ্রের কার্বন চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এমনকি গ্রিনহাউজ প্রভাবও কমায়। গবেষণা অনুসারে, এগুলো কীটনাশকের মতো সাগরের দূষণগুলোকে শুষে নেয়।
আকার ও মানের ওপর নির্ভর করে প্রতিটি স্পঞ্জ বিক্রি হয় ৩৭ হাজার থেকে ৭৪ হাজার ৯০০ তানজানিয়ান শিলিং (১৫ থেকে ৩০ ডলার)। পর্যটক ও স্থানীয় হোটেলে বিক্রি করা হয়। বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক স্পঞ্জের বাজার জাঞ্জিবারের বাইরেও বিস্তৃত। যেখানে ফেডারেটেড স্টেটস অব মাইক্রোনেশিয়া এবং তিউনিসিয়াসহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে সমৃদ্ধ চাষাবাদ এবং ফসল সংগ্রহ করা হয়। স্পঞ্জগুলো তাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্থায়িত্বের জন্য বেশ মূল্যবান। লোশন, ফেস পাউডার ও বিভিন্ন বিউটি পণ্যে ব্যবহারসহ বিশ্বব্যাপী গৃহস্থালিতেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।