কথায় আছে, সবাই সুযোগে প্রতারণা করে না, কারও কাছে তা পছন্দের। এমনই এক শখের প্রতারক মো. রফিকুল হক মিঞা রফিক (২৮)। সুনিপুণ প্রতারণার মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। যেন প্রতারণার পিএইচডিধারী। কখনো নিজেকে পরিচয় দেন সিনিয়র সহকারী সচিব, কখনো সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবারও কখনো পুলিশের এএসপি বলে। শুধু তাই নয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে খোদ রাজধানীতেই রোগী দেখেন নিয়ম করে। এ ছাড়া লেখক এবং মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিত। যদিও দিনশেষে সবকিছু ছাপিয়ে এক মহাপ্রতারক তিনি। অর্থ উপার্জনের জন্য যখন যাকে যে পরিচয়ে আকৃষ্ট করার তখন তাকে সেই পরিচয়ই দেন। আর পরিচয় বিশ্বাসযোগ্য করতে তৈরি করেছেন ভিজিটিং কার্ডও। শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও একেকবার একেক তথ্য দেন। সম্প্রতি এ প্রতারক ধরা পড়েছে পুলিশের জালে।
প্রাথমিকভাবে জানা যায়, গ্রেপ্তার রফিক মিরপুর মধ্য পীরেরবাগ এলাকার বাসিন্দা। বাবার নাম মো. শামছুল হক মিঞা। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে প্রতারণার দায়ে মিরপুর মডেল থানার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রফিক সিনিয়র সহকারী সচিব ভুয়া পরিচয়ে তদবির করতে যান মিরপুর মডেল থানার ২ নম্বর সেকশনের পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনারের (মিরপুর জোন) অফিসে। কিন্তু সন্দেহ হলে সেখানে তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। একপর্যায়ে অসংলগ্ন কথা বলতে শুরু করেন তিনি। একসময় জিজ্ঞাসাবাদের মুখে স্বীকার করেন, তিনি কোনো সচিব নন। প্রতারণাই মূলত তার পেশা।
অনেক সময় রফিক নিজেকে পরিচয় দেন পুলিশের এএসপি হিসেবেও। তা প্রমাণের জন্য কায়দা করে ৪০তম বিসিএসের গ্যাজেট এডিট করে নিজের নাম বসান তিনি। এ ছাড়া কারো কারো কাছে তিনি সাবেক সেনা কর্মকর্তা। আর সে হিসেবে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর নির্বাচন পরীক্ষা আইএসএসবিতে সুযোগ পাওয়ার জন্য বইও লিখেছেন তিনি। বইটির প্রচ্ছদে লেখা বাংলাদেশের প্রথম আইএএসবি অনুশীলনী বই ‘স্যালুট’। সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়ার একটি ধাপ এই ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড বা আইএসএসবি পরীক্ষা। প্রাথমিক বাছাই ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ডাকা হয় এ পরীক্ষায়। চার দিন ধরে প্রার্থীর মনস্তাত্ত্বিক, বুদ্ধিমত্তা, শারীরিক দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব, বিচারবোধ, উপস্থিত বুদ্ধি, পরিকল্পনা ক্ষমতা, নেতৃত্বের দক্ষতা ইত্যাদি দেখা হয়। অথচ ওই বইয়ের লেখক পরিচিতিতে বলা হয়েছে দীর্ঘ ৯ বছর তিনি ওই প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত। আবার শুধু বই লিখেই ক্ষান্ত হননি। বাস্তবেও আইএসএসবি ফুল কোর্স করানোর জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, খুলেছেন প্রতিষ্ঠান।
প্রতারণার এখানেই শেষ নয়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে রোগীও দেখে নিয়ম করে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, অনিদ্রা, বুক ধড়ফড়, মানসিক দুর্বলতা আর বিষণ্নতার মতো রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে দাবি করেন নিজেকে। রফিক একজন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারও। ফেসবুকে তার ফলোয়ার সংখ্যা ২ লাখ ৮৩ হাজার। পাশাপাশি তিনি মোটিভেশনাল স্পিকারও।
মিরপুর মডেল থানার ওসি মো. মহসীন কালবেলাকে জানান, প্রতারক রফিক আসলেই কী করেন সে বিষয়েও ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। কখনো জানান, তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আবার জানান, কোচিং সেন্টার চালান। তবে নিজেকে পরিচয় দেয় সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে। ৩৫তম বিসিএস পাস করে বর্তমানে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে উপপরিচালক পদে কর্মরত বলেও দাবি করেন। সেই পরিচয়ে ছাপিয়েছেন ভিজিটিং কার্ডও। থানায় তার ভিজিটিং কার্ড দেখালেই ‘কাজ হয়ে যাবে’ বলে সবাইকে গল্প করে। গত ১৬ নভেম্বর রাতে তার ভিজিটিং কার্ড নিয়ে মিরপুর জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনারের কাছে আসেন আনু মিয়া নামে এক ব্যক্তি। কার্ড দেখে সন্দেহ হলে চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে ওই অফিসে ডাকা হয়। আসার পরিচয়, কর্মস্থলসহ নানা বিষয়ে জানতে চাইলে অসংলগ্ন কথা বলা শুরু করেন ভুয়া সচিব রফিক। পরে কথিত কর্মস্থলে যোগাযোগ করা হলে এই নামে সেখানে কেউ নেই বলে জানান তারা। একপর্যায়ে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ভুয়া পরিচয়ের কথা স্বীকার করেন।
ওসি আরও বলেন, তার মূল পেশা হচ্ছে প্রতারণা। প্রতারণা সব শাখায় তার বিচরণ। প্রাথমিকভাবে তিনি যেসব তথ্য দিয়েছেন সেগুলো বিস্তারিতভাবে যাচাই করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কতজনের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এবং কী পরিমাণ অর্থ হাতিয়েছেন রিমান্ডে এনে সে বিষয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।