গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে গ্রামীণ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ কাগজ ও দলিলপত্র ধ্বংসের অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল মজিদ। গত শনিবার রাজধানীর মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই অভিযোগ করেন।
অধ্যাপক সাইফুল মজিদ বলেন, ‘তিনি (ইউনূস) গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ধ্বংস করেছেন। আমরা এখন অডিট করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ খুঁজে পাচ্ছি না।
১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত গ্রামীণের অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ নথি তিনি সরিয়ে ফেলেছেন।’ এ সময় অধ্যাপক সাইফুল গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। তবে পূর্ণাঙ্গ অডিট না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দায়ী করবেন না বলেও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদ, পরিচালক মোহাম্মদ জুবায়েদ, আইন উপদেষ্টা মাসুদ আক্তারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে গ্রামীণ টেলিকম ভবনে থাকা একাধিক প্রতিষ্ঠানে তালা দেওয়ার পর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংকটের সূত্রপাত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ইউনূস অভিযোগ করেন, ১২ ফেব্রুয়ারি টেলিকম ভবনে থাকা ১৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আটটি প্রতিষ্ঠানে তালা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওই ১৬ প্রতিষ্ঠানে গ্রামীণ ব্যাংকের কোনো টাকা নেই।
অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল মজিদ বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ৫১-৫২টি।
প্রতিষ্ঠানের মালিক সরকার ও ঋণদাতা জনগণ। ড. ইউনূসের কোনো ধরনের মালিকানা বা শেয়ার নেই। গ্রামীণ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা সাইফুল মজিদ জানান, আইন মেনেই গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তি—এই সাতটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফান্ড—এই তিনটি কম্পানি থেকে ড. ইউনূসের চেয়ারম্যান পদের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তিনি আইনবহির্ভূতভাবে ওই পদে ছিলেন।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাইফুল মজিদ বলেন, ‘১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত বছর আমরা সাত মাস সময় নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকে একটি কম্প্রিহেনসিভ অডিট করেছি। ১৯৮৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কম্প্রিহেনসিভ অডিটে অনেক কাগজপত্র, নথি খুঁজে পেয়েছি। সেসব নথিতে আমরা দেখেছি, গ্রামীণ ব্যাংকের স্বার্থ অনেক ক্ষুণ্ন হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’
মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণের অনেক প্রতিষ্ঠানের টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে জানিয়ে সাইফুল মজিদ বলেন, ‘অনেক টাকা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সরানো হয়েছে। সেটা আমরা অনুসন্ধান করছি, অনেক আলামত আমরা সংগ্রহ করেছি। অনেক তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে অথবা নেই বা ধ্বংস করা হয়েছে। পূর্ণ তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কাউকে দোষারোপ করছি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্রামীণের অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সাল, ওই সময়ের কোনো খতিয়ান খুঁজে পাইনি। যেহেতু আমরা পাইনি, আমরা জিডি করেছি। আমরা চাই, আমরা অনুরোধ করব প্রফেসর ইউনূস যেন ওগুলো ফেরত দেন।’
আইনি বৈধতার ভিত্তিতে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গ্রামীণ টেলিকম ভবনে থাকা তিনটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের নমিনেশন দিয়েছে জানিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, নমিনেশন গেলে আইনি মতে আগে যিনি ছিলেন তাঁর চেয়ারম্যানশিপ শেষ হয়ে যাবে। আইন অনুযায়ী ড. ইউনূস ওই সব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নন। গ্রামীণ টেলিকম ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করা হয়নি।
গ্রামীণ ব্যাংক ড. ইউনূসের আটটি প্রতিষ্ঠান দখল করেছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সেটি সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেন সাইফুল মজিদ। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৪২তম সভায় কম্পানি আইনের আলোকে ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ কল্যাণ গঠিত হয়। আর্টিকলস অব অ্যাসোসিয়েশনের ৪৮ নম্বর ধারায় বলা আছে, গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণ কল্যাণের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিতে পারবে।
গ্রামীণ ব্যাংক চেয়ারম্যানের দাবি, গ্রামীণ কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৪৪৭ কোটি টাকা নিয়েছেন। গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২৪ কোটি টাকা অনুদান নিয়েছেন। কিন্তু গ্রামীণ টেলিকম এ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংককে সুদ ও লভ্যাংশ বাবদ কোনো টাকা দেয়নি। ড. ইউনূসের কোনো মালিকানা গ্রামীণের ৫১টি প্রতিষ্ঠানে নেই জানিয়ে অধ্যাপক সাইফুল বলেন, ‘উনাদের কোনো শেয়ারহোল্ডিং নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক আমরা গ্রামীণ ব্যাংক না। এসব গ্রামীণের নিয়ন্ত্রণে, গ্রামীণ ব্যাংকের অঙ্গসংগঠন।’