নিজের হাত ধরে বেগম রোকেয়ার এই রত্ন মার্কিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সে জায়গা করে নিয়েছে, আমার জন্য এ এক ভীষণ আনন্দের ব্যাপার।
বেগম রোকেয়ার সঙ্গে তাসনুভার পরিচয় নবম শ্রেণিতে থাকতে। ‘জাগো গো ভগিনী’ দিয়ে। ‘প্রবন্ধটা আমার মনোজগতে ভীষণ নাড়া দেয়।
তাসনুভা তখনো থাকতেন নিজের শহর ময়মনসিংহে। এখান থেকেই স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে পাড়ি জমান সিলেটে। ২০০৮-০৯ সেশনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি হন ইংরেজি বিভাগে।
স্নাতকের পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগ থেকে ২০১২-১৩ সালে স্নাতকোত্তর করেন তাসনুভা।
শিক্ষক হিসেবে তাসনুভা বরাবরই ছাত্র-ছাত্রীদের জানার আগ্রহকে উৎসাহ দিতেন। বলেন, ‘ক্লাসে ওরা এমন প্রশ্নও করত, যেগুলোর উত্তর আমার জানা নেই। এতে একটুও রাগ করতাম না, বরং সেগুলো নিয়ে পড়াশোনা করে এসে ওদের উত্তর দিতাম। ওদের চোখেমুখে যে জানার আগ্রহ দেখতাম, সেটাই আমাকে উৎসাহিত করে দ্বিতীয়বারের মতো মাস্টার্স করতে, যেন আরো ভালো শিক্ষক হতে পারি।’
সে জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার তাঁর পছন্দের তালিকায়ই ছিল না। সেখানকার কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি আবেদন করেছিলেন। ২০২২ সালে। মিসৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ফল সেমিস্টারে আবেদনের শেষ সময় ছিল মার্চ মাস। তাসনুভা আবেদন করেন ফেব্রুয়ারিতে। মার্চে অনলাইনে দেন সাক্ষাৎকার। সপ্তাহ না ঘুরতেই আসে সুসংবাদ। কেবল বিনা বেতনে পড়ার সুবিধাই নয়, ইংরেজি বিভাগে গ্র্যাজুয়েট টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের বিপরীতে বৃত্তিও পান ।
‘তবে মার্কিন ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়াটা ছিল এর চেয়েও কঠিন। সব প্রক্রিয়া শেষ করে যখন ভিসা অফিসারের সামনে সাক্ষাৎকারের জন্য দাঁড়ালাম, ক্লাস শুরু হতে বাকি ছিল মাত্র ১৭ দিন! এই দুঃস্বপ্নের যাত্রার পুরোটা সময় পাশে ছিল মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীরা। অবৈতনিক শিক্ষা ছুটি নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে বিমানের টিকিট জোগাড় করে দেওয়া, সব কিছুতেই ওরা সাহায্য করেছিল। আর ছিলেন মা। তিনি কেবল আমাকে আগলেই রাখেননি, সারা জীবন পথ দেখিয়ে গেছেন,’ বলেন তাসনুভা।
অবশেষে তাসনুভা পাড়ি জমান মার্কিন মুলুকে। সেখানে করছেন মাস্টার্স। তাঁর থিসিসের বিষয় পুরুষত্ব ও নারীবাদ নিয়ে। কাজেই সেখানে চলে এলো ‘সুলতানার স্বপ্ন’। বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার এই ঔপন্যাসিকার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল স্নাতকে পড়ার সময়। যখন মুসলিম নারীদের পড়ারই সুযোগ হতো না, তখন এমন দুর্দান্ত নারীবাদী ইউটোপিয়া তিনি কিভাবে লিখেছিলেন, সেটা ভেবেই বিস্ময়ের সীমা ছিল না। তিনি এটা প্রথমে ইংরেজিতে লিখেছিলেন [ঝঁষঃধহধ’ং উত্বধস] জেনে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যাই।’ থিসিসের বিষয় অনুমোদনের জন্য তাঁর প্রয়োজন ছিল তিনজন রিডারের অনুমতি। সে জন্য তিনজন অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাসনুভা। তাঁরা হলেন ড. শ্যানন উডেন, ড. লেনিয়া ল্যামোরিয়া ও ড. মার্গারেট উইভার। রাজি হন তিনজনই। কিন্তু তাঁরা কেউই ‘সুলতানার স্বপ্নে’র সঙ্গে পরিচিত নন। কাজেই তাঁদের বইটা পড়তে দেন তাসনুভা। “সপ্তাহ দুয়েক পরে যখন ড. লেনিয়া ল্যামোরিয়ার কাছ থেকে বই ফেরত নিতে যাই, আমাকে চমকে দিয়ে বলেন, তিনি এরই মধ্যে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ অর্ডার দিয়েছেন। বইটা তাঁর এতটাই ভালো লেগেছে,” বলেন তাসনুভা।
তবে সবচেয়ে বড় চমকটা দেন তাঁর প্রথম রিডার ড. শ্যানন উডেন। অবশ্য তাসনুভাই তাঁকে প্রথমে চমকে দেন ‘সুলতানার স্বপ্ন’র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে। কারণ পশ্চিমের কাছে প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ান সাহিত্য হিসেবে পরিচিত শার্লট গিলম্যানের ‘হারল্যান্ড’। সেটা প্রথম পত্রিকায় ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৯১৫ সালে। অথচ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ মাদ্রাজের দি ইন্ডিয়ান লেডিস ম্যাগাজিনে মূল ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে। আর বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে। বাংলায় ১৯২২ সালে। অন্যদিকে ‘হারল্যান্ড’ বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় আরো অনেক পরে, ১৯৭৯ সালে এসে।
নতুন এই বিস্ময়ের খোঁজ পেয়েই তা পড়তে লেগে যান ড. শ্যানন উডেন। তারপর যোগ করে নেন ডিসটোপিয়ান ও ইউটোপিয়ান সাহিত্য নিয়ে তাঁর কোর্সের সিলেবাসে। এরই মধ্যে তাঁর শিক্ষার্থীরা পড়তে শুরু করে দিয়েছে ‘সুলতানার স্বপ্ন’। পছন্দও করছে। তাসনুভা বলেন, ‘নিজের হাত ধরে বেগম রোকেয়ার এই রত্ন মার্কিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সে জায়গা করে নিয়েছে, আমার জন্য এ এক ভীষণ আনন্দের ব্যাপার।’ হবে না-ই বা কেন! বাংলার নারীরা যে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আজ এত দূর এসে দাঁড়িয়েছে, তাসনুভারা নিজের চেষ্টায় হাজার মাইল দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছেন, পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন, সেই পথটা তো সৃষ্টি করেছিলেন বাংলার নারী জাগরণের এই অগ্রদূত।