বাংলা একাডেমির ওয়েবসাইটে ঢুকলেই ডানপাশে সবার ওপরের বক্সে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছবি, ক্যাপশনে লেখা বাংলা একাডেমির স্বপ্নদ্রষ্টা। জাতির মননের প্রতীকখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় কেন্দ্রে শহীদুল্লাহ রচনাবলী কিনতে গিয়ে জানা গেল, যে তিন খণ্ড বের হয়েছে তার কপি সর্বশেষ বিক্রি হয়েছে ছয় বছর আগে। বিক্রয় বিভাগে কোনো কপিই অবশিষ্ট নেই আর।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উত্তরাধিকার লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক শান্তা মারিয়ার কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল আরও আশ্চর্য তথ্য। তিনি বললেন, তার জানা মতে বাংলা একাডেমি তার দাদার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছে। তার বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ষষ্ঠ সন্তান মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ, যিনি ভাষাসৈনিক ও বামপন্থি আন্দোলনের নেতা ছিলেন, তিনি ২০০২ সালের মধ্যে পঞ্চম খণ্ড পর্যন্ত সব পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমিতে জমা দিয়েছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বাবা অনেকবার অসুস্থ শরীর নিয়েও বাংলা একাডেমিতে গেছেন, জিজ্ঞেস করেছেন, বাংলা একাডেমি বারবারই বলেছে প্রকাশ হবে। এরপর আর প্রকাশিত হয় নাই। ২০০৯ সালের পর তিনি অসুস্থ হয়ে গেলে এই ব্যাপারে আসলে ফোন করা ছাড়া খোঁজ নিতে পারেন নাই। কিন্তু তখনো তিনি কোনো ইতিবাচক সাড়া পান নাই। মৃত্যু পর্যন্ত আমার বাবা অপেক্ষা করেছেন।’
শান্তা জানান, ‘২০১৮ সালে তাকে জানানো হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলীর পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমি খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি আবার দিতে পারেন কি না।’
ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দেবই-বা কেন, বাংলা একাডেমি তো আনুষ্ঠানিকভাবে আমার কাছে কখনই চায়নি। আর আমার বাবার দেওয়া পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলবে এটা তো খুবই লজ্জাজনক। এ রকম একজন মনীষী, বাংলা ভাষা গবেষণার প্রধান পুরুষের রচনাবলী, যিনি আবার একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ, তারই প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমি তার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছে, এর চেয়ে দুঃখজনক ও লজ্জাজনক কাজ আর হতে পারে না। এটা তো জাতির জন্যও লজ্জাজনক।’
তিনি বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কাজটি কেন করা হচ্ছে না জানতে চাইলে শান্তা মারিয়া বলেন, ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী প্রকাশ করা বাংলা একাডেমির কাজ, শহীদুল্লাহ পরিবারের কাজ না। আমার বাবা করেছেন তার বাবার জন্য, অথচ বাংলা একাডেমি তাকে ফেলোশিপও দেয় নাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কোনো স্বীকৃতি পান নাই, মৃত্যুর পর তিনি একুশে পদক পান। এটা একটা শ্রমসাধ্য কাজ, জাতীয় দায়িত্ব তো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের, আমার না। তবে বাংলা একাডেমি প্রস্তাব দিলে আমি সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত।’
শান্তা মারিয়া জানালেন, শহীদুল্লাহর রচনার কিছু তাদের কাছে আছে। তার বাসায় অনেক বইয়ের আলমারি। তার বাবা কোথায় রেখে গেছেন তিনি জানেন না। বললেন, ‘বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে সহায়তা চাইলে আমি অবশ্যই দেব। কিন্তু আমার বাবার ক্ষেত্রে দেখেছি, উনি সারাজীবন খেটেছেন, সম্পাদনামণ্ডলীতে তার নামটা পর্যন্ত দেওয়া হয় নাই। উনি নামের ব্যাপারেও সচেতন ছিলেন না, আমি আমার নামের ব্যাপারে সচেতন।’
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলীর প্রথম খণ্ড বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায়, দ্বিতীয় খণ্ড ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় পরের বছরের জুন মাসে। প্রথম দুই খণ্ড আনিসুজ্জামান সম্পাদিত এবং তৃতীয় খণ্ড আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ সম্পাদিত।
শহীদুল্লাহ রচনাবলীর চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলার বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাপারটি ‘গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ’ দেখে, সে বিভাগের পরিচালকের কাছে যেন খোঁজ নেয় দেশ রূপান্তর।
বাংলা একাডেমির সংশ্লিষ্ট বিভাগটির পরিচালক মো. মোবারক হোসেন (কবি সাজ্জাদ আরেফিন) অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি আমাদের কাছে নেই। যখন এ রচনাবলীর কাজ হয় তখন আমি বিভাগের সহকারী পরিচালক ছিলাম, পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সেলিনা হোসেন। দুই দফায় বিভাগের অফিস স্থানান্তরের কারণে আমরা মূল হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি এবং প্রযুক্তিগত বদলের কারণে টাইপ করা (সফট কপি) পাণ্ডুলিপিও হারিয়েছি। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পরিবারের পক্ষ থেকে আবারও দেওয়া না হলে বাংলা একাডেমি এই রচনাবলী প্রকাশ করতে পারবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার চাকরি আর এক বছর আছে, আমি আনিসুজ্জামান স্যারের মতো আফসোস করতে চাই না, এই রচনাবলীটি প্রকাশ করে আমি যেতে চাই। সত্যি কথা বলতে, আমি ছাড়া এটি এখন আর কেউ শেষও করতে পারবে না হয়তো।’ তিনি জানান, তার কাছে পুরো রচনাবলীর সূচিপত্র রয়েছে।
মোবারক হোসেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান তার স্বপ্নদ্রষ্টার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলবে? তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমির অযোগ্য লোকবল, মাঝখানে সরকার বদলের কারণে কাজের স্থবিরতা এসবই দায়ী আসলে। সবচেয়ে বড় কথা, কাজটি পরিবার বা একাডেমির কর্তারা কেউ ভালোবেসে করেননি।’
মোবারক বলেন, তিনি শহীদুল্লাহ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। একাডেমির মহাপরিচালক ও সভাপতিরও দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলে জানান।
মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা পান্ডুলিপি হারানোর বিষয়টি জেনে অবাক হন। ১০ জুলাই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্মদিনে এ ব্যাপারে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পরিবারের সহযোগিতা চাই, সেটি হলেই যথাদ্রুত সম্ভব রচনাবলী প্রকাশ করা যাবে। পরিবারের পক্ষ থেকে কপিরাইট ডিস্ট্রিবিউশনও এই কাজটির পক্ষে একটি বাধা। সেটিতে সহায়তা না পেলে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানের জাতীয় দায়িত্ব পালনেরও আসলে উপায় নাই।’
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন ঘটনাটি মানতেই পারছেন না। তিনি উল্টো প্রশ্ন করে জানতে চেয়ে বলেন, ‘ঘটনাটা আসলেই কি সত্যি? বাংলা একাডেমি যদি সত্যি সত্যি ড. শহীদুল্লাহর পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলে থাকে, তাহলে এর চেয়ে গর্হিত কাজ আর দ্বিতীয়টা হয় না। এটাকে আমি কবিরা গুনাহ বলে মনে করি। বাংলা একাডেমি কোন মুখে তাদের ওয়েবসাইটে লিখে রাখতে পারে যে শহীদুল্লাহ ছিলেন বাংলা একাডেমির স্বপ্নদ্রষ্টা? পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলল সেই প্রতিষ্ঠান, যার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন? তার মৃত্যুর পর যে পাণ্ডুলিপি এভাবে তারা হারিয়ে ফেলবে সম্ভবত এটি তিনি দুঃস্বপ্নেও কখনো ভাবেননি।’
তিনি বলেন, গোটা ভারত উপমহাদেশে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো এত বড় একজন ভাবুক, মননশীল পণ্ডিতের রচনাবলী হারিয়ে ফেলার পেছনে কতটা অবজ্ঞা-অবহেলা থাকতে পারে তা ভেবে আমি সত্যি সত্যি বিমর্ষ বোধ করছি। যিনি এই জাতির ভাষার লড়াইয়ের প্রথম এবং প্রধান তাত্ত্বিক পুরুষ, যিনি বাঙালিত্বের ধারণার প্রথম ও প্রধান চিন্তানায়ক, যিনি আমাদের জন্য একটি ভূখণ্ডের কল্পনা করেছিলেন, আমাদের ভাষা ও ভাবনার বংশলতিকা অনুসন্ধান করে একটি পূর্ণাঙ্গ চেহারা হাজির করেছেন, সেই আমরা তার সঙ্গে এ রকম গাদ্দারি কীভাবে করতে পারি?’